সালেক সুফী।।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাপান , যুক্তরাষ্ট্র ,যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচন, রিজার্ভ পরিস্থিতি , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক , জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেসব দেশ বাংলাদেশকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বা দিবে তাদের কাছ থেকে কিছু ক্রয় বা আমদানি না করা। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ভাবে অনেক কথা নানা সময় বলার জন্য বলেন। তিনি সরকার প্রধান বলে অনেকগুলো বাস্তবায়ন হয় কিছু হয় না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কথা নিয়ে প্রতিবাদ বা বিতর্ক করবো না।বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান মেরুকরণ সময়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উভয় সংকট বৈদেশিক সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখা। তাই নাজুক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে নানা জন নানা সমীকরণ করতে পারে।
বাংলাদেশকে এযাবৎ একমাত্র একটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথিত অভিযোগে এলিট র্যাবের বাহিনী কিছু প্রাক্তন এবং বর্তমান কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সেটি নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। র্যাব যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সৃষ্ট এবং র্যাবের কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। হয়তো কোনো নিদৃষ্ট কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মাঝে মাঝে ওরা বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। যেমন মায়ানমারের বিরুদ্ধে , রাশিয়ার বিরুদ্ধে , ইরান , ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিন্তু বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় নি।জানিনা প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশো করেই কথাটি বলেছেন কিনা। তবে দেখতে হবে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি হলে সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতি বহন করতে পারবে কিনা।
বর্তমানে পারস্পরিক বাণিজ্যিক ভারসাম্য কিন্তু বাংলাদেশের অনুকূলে।বর্তমানে আমদানির চেয়ে সাড়ে তিন গুণ বেশি পণ্য বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়, যা মোট রপ্তানির ১৯ শতাংশ। মূল রপ্তানি পণ্য বাংলাদেশের তৈরী পোশাক। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক সূত্রে জানা গাছে বাংলাদেশের আমদানির মাত্র ৩.৭ % যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে.২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭৪০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে আমদানি করেছে ২৮৩ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি স্থগিত করলে কিছু যাবে আসবে না। ওই সব পণ্য বহু দেশ কিনে নিবে। কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র পণ্য আমদানি স্থগিত করলে মহাবিপদ হবে বাংলাদেশের। পোশাক শিল্পে সৃষ্টি হবে মহাসংকট।
২০২১-২২ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি মোট রপ্তানি আয়ের ১৯.২ শতাংশ। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে খনিজ পণ্য, জ্বালানি উপকরণ, বিটুমিন, আয়রন, স্টিল, তৈলবীজ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, সুতা, ওষুধ পরমাণু উপকরণ।এ ছাড়া শিল্পের যন্ত্রপাতি, রেলওয়ে সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক ও ফটোগ্রাফিক উপকরণ, রাসায়নিক পণ্য, জাহাজ, আধুনিক নৌকা ও জৈব পণ্যও আমদানি হচ্ছে । এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে খনিজ পণ্য।এর বিপরীতে দেশটিতে বাংলাদেশ রপ্তানি করছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, পাটজাত পণ্য, চামড়া ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক।৬৯০ কোটি ডলার আয় হয়েছে পোশাক রপ্তানি থেকে। এ ছাড়া হিমায়িত খাদ্য ৪ কোটি ডলার, হোম টেক্সটাইল ৬ কোটি ডলার, পাটজাত পণ্য ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার, চামড়াজাত পণ্য ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার, হস্তজাত পণ্য ৬০ লাখ ডলার ও অন্যান্য পণ্যে ২৭ কোটি ডলার আয় হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির মধ্যে ৮৮ শতাংশই তৈরি পোশাক। বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য পণ্য।
রাজনৈতিক সম্পর্ক সাধারণত অর্থনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না।এই যে মায়ানমার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এতো সোচ্চার তখনও অস্ট্রেলিয়া , যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউ দেশগুলোতে মায়নামারের মানুষগুলো থাকছে ,ব্যবসা বাণিজ্য করছে। চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকার পরেও পশ্চিমা বিশ্বে চুটিয়ে ব্যবসা করছে চীন।আর বাংলাদেশের পক্ষে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ করা বাস্তব সম্মত না।নানা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া সংকটে পর্বে বাংলাদেশ।
কি অবস্থার প্রেক্ষিতে , কি সংকেত দেয়ার জন্য প্রধান মন্ত্রী তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন তিনি জানেন. মনে হয় এভাবে কথাটি উনি না বললেই ভালো হতো. সর্বোপরি উনি নিজে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে আসলেন তখন এই ধরণের কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে হয় নি। কথাগুলো বাস্তব সম্মত নয়।
প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হটাৎ করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্য , ভারত এবং সৌদি আরব কূটনীতিকদের বিশেষ পুলিশ প্রহরা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিলেন। ঢাকায় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে চার দেশের রাষ্ট্রদূতদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রদান করা হতো. দেশের রাজনীতিতে বিদেশী দূতাবাস সম্পৃক্ত হওয়া নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন হটাৎ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়. আর এটি এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেয়ার কি আছে।
সবাইকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের যেমন বহির্বিশ্বে বন্ধু আছে ,বৈরী ভাবাপন্ন মহলও আছে। অত্যন্ত নাজুক সময়ে সব কিছু গভীর চিন্তা করে করা উচিত। সবকিছু সবাইকে খোলামেলা জানানোর প্রয়োজন নেই। কিছু কৌশলগত স্পর্শকাতর বিষয় কৌশলগত ভাবেই করতে হয়। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যেভাবে নিরাপত্তা দিতে হয় সেটি বাংলাদেশকে দিতেই হবে।আর কূটনীতিকদের দায়িত্ব আছে সীমানা অতিক্রম না করা।