সালেক সুফী।।
করোনা উত্তর বাংলাদেশ অর্থনীতি উক্রেন যুদ্ধের অশুভ প্রভাবে কিন্তু এখনো ভঙ্গুর। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দুটি খাত রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স দুটি খাতেই কিন্তু প্রবৃদ্ধি সীমিত। রপ্তানি আয় থেকে আমদানি ব্যায় বেশি বাড়তে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমছে ক্রমান্বয়ে। সরকার আমদানি বিষয়ে রক্ষণশীল হলেও বায় সংকোচন বিষয়ে নেয়া কার্যক্রম গুলো কঠোর ভাবে পালিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।ফলশ্রুতিতে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদির মূল্য বাড়ছেই। সীমিত আয়ের মদ্ধ বৃত্তের এখন নাভিশাঁস উঠছে। নিম্ন বিত্তের কথা না হয় নাই বা বললাম। এরই মাঝে ঘনিয়ে আসছে মেগা প্রকল্পগুলোর সুদ সমেত ঋণ পরিশোধের দায়। এরই মাঝে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক সংকট উৎবিঘ্ন করছে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিদের। প্রধানমন্ত্রী জাপান , যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রকে পরোক্ষ ভাবে উদ্দেশো করে বলেছেন ” যে সব দেশ বাংলাদেশকে নিষেধাজ্ঞা দিবে তাদের কাছ থেকে কিছু কিনবে না বাংলাদেশ”. প্রধানমন্ত্রীর বলা এই কথার বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাবো না। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে অবশ্য একক বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই শীর্ষে।পণ্য রপ্তানিতে অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে জার্মানি বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য হলেও সেটি বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। যদিও মোট পণ্য রপ্তানির ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। এই বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত অর্থবছর ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির মধ্যে তৈরি পোশাকই ছিল ৮৬ শতাংশ, যা পরিমাণে ৯০১ কোটি ডলার। এ ছাড়া ৩১ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের ২১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইলের ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর স্টেটমেন্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র আমদানি রপ্তানিতে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে এবং একই কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে
আমদানি রপ্তানি প্রভাবিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। তারপরের অবস্থানে আছে ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রাজিল, কাতার ও সৌদি আরব। অর্থাৎ আমদানিতে ষষ্ঠ অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু আমদানি না করলেও ওদের কিছুই যাবে আসবে না।কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে শুধু পোশাক আমদানি কমায় তাহলে রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নামবে।
বাংলাদেশ আমদানি রপ্তানি খাতের ঘাটতি পোষায় মূলত রেমিটেন্স আয় থেকে। সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য আছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৫৪ কোটি ডলারের জোগানদাতা হচ্ছেন সৌদি আরবে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারপরই সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর পরিমাণ ৩৪৪ কোটি ডলার। আর ইউএই থেকে গত বছর ২০৭ কোটি ডলারের তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে।
নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের মতবিরোধ থাকতেই পারে। তাই বলে দুই দেশের পারস্পরিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিষয়গুলো সমাধান হওয়া জরুরি। এগুলো বাণিজ্যিক সম্পর্কে টেনে আনা সঠিক কৌশল না।
বর্তমান সরকারের ক্রমাগত তিন টার্মে অর্থনীতির আকার বেড়েছে বহুগুন, সরকারের হিসাবে মাথাপিছু আয় বাড়ার কথা বলা হলেও সেই বৃদ্ধি সুষম হয়েছে বলা যাবে না।একটা পর্যায় পর্যন্ত দারিদ্রের হার কমলেও গত দুই বছরে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আবার দারিদ্র সীমার নিচে চলে গেছে। কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় হয়তো খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয় নি। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারসাজিতে অহরহ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কিছু পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে জনগণকে হোস্টেজ বানানো হচ্ছে। সরকারের অন্নতম সাফল্যে সারা দেশকে গ্রিড বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনা। কিন্তু একই সঙ্গে বড় ব্যার্থতা ভুল কৌশলের কারণে নিজেদের প্রাথমিক জ্বালানী উন্নয়ন উপেক্ষা করে এবং আমদানি কৃত জ্বালানি নির্ভর হয়ে পড়া। ফলশ্রুতিতে বার বার বিশ্ব বাজারে জ্বালানির অগ্নিমূল্যের চাপ, আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জ্বালানীর সাপ্লাই চেন ব্যাহত হচ্ছে। ২৫০০০ মেগাওয়াটের অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও ১৬০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে পারছে না।ডলার সংকটে কয়লা , জ্বালানি তেল এবং এলএনজি কেনায় সমস্যা। আইপিপি এবং আইওসি গুলোকে পাওনা পরিশোধ করতে টানপোড়ন যাচ্ছে।
আশা করি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি আরো লাগসই এবং বাস্তবধর্মী হবে। কৌশলগত কারণে কথা বলায় সংযত হতে হবে।