সালেক সুফী।।
হল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পথে ডাচ ইমিগ্রেশন আমাকে কিছুক্ষনের জন্য আটকে দিয়েছিলো। আমার পাসপোর্টের ছবিটি ছিল ১৯৭২ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে তোলা। লম্বা চুল ছবিটির সাথে ১৯৮৮ আমাকে মেলাতে পারছিলো না. আমি কিন্তু আদৌ ঘাবড়ে যাই নি. সঙ্গী সবাই চলে গেছে। বিমান ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। অবশ্য অনেক পরীক্ষার পর চার পেলাম। দুঃখ প্রকাশ করে ওরা আমাকে এককাপ গরম কফি এবং টিউলিপ ফুল উপহার দিয়ে বিশেষ ব্যাবস্থায় বিমানের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো। আমি শেষ মুহূর্তে কিছু বেলজিয়ান চকলেট কিনেছিলাম। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে আমার ছোট ছেলে অভ্রকে কোলে নিয়ে রোজী এবং বড় ছেলে শুভ্রকে দেখে সব ভুলে গেলাম। ঢাকায় মাত্র ৭ দিন থাকতে পেরেছিলাম। বিজিএসএল ব্যাবস্থাপনা পরিচালক পেট্রোবাংলার অফিস আদেশ মেনে আমাকে সিলেট গ্যাস ফিল্ডে বদলির জন্য ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করায় পেট্রোবাংলা আমাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে ৭ দিনের মধ্যে যোগদানের নির্দেশ দেয়। দেশদ্রোহী সালেক সুফী তিন মাস পশ্চিম ইউরোপ গ্যাস সঞ্চালন এবং বিতরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর উৎপাদন কোম্পানিতে বদলি হন। দীর্ধদিন পর দেশে ফিরে আমার সদ্যোজাত শিশু সন্তান সহ পরিবারের সঙ্গে বেশি দিন থাকার সুযোগ হয় নি।অনিশ্চিত অবস্থায় আমার পক্ষে পরিবার নিয়ে তাৎক্ষণিক সিলেট যাওয়া সম্ভব ছিল না।
আমি নিজেও কিছুটা দো টানায় ছিলাম। এমনিতেই গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিতে কাজ শেখার সুযোগ তদুপরি বাংলাদেশের প্রথম তেল কূপ পরিচালনায় সম্পৃক্ত হওয়া। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ঢাকা লিয়াজো অফিসে যোগদানের পর আমাকে ব্যাবস্থাপক উৎপাদন পদবী দিয়ে চিকনাগুল সদর দপ্তরে যোগদানের অফিস আদেশ দেয়া হলো।ইতিমধ্যে আমি মালিবাগ চৌধুরী পাড়া ময়না ভাইদের বাসা ছেড়ে কাছেই আরো একটি ছোট বাসায় রোজিদের থাকার ব্যবস্থা করলাম। শুভ্র তখন সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। নিদৃষ্ট দিনে রেলপথে সিলেট পৌঁছানোর পর সিলেট রেল স্টেশনে ফুলেল অভ্যর্থনা জানালো নতুন কোম্পানি। পাহাড় বন বনানী ঘেরা সিলেট গ্যাস ফিল্ড প্রথম দেখায় ভালো লাগলো। মহাব্যবস্থাপক মীর নাজির আহমেদ, সহকর্মী ফজলুল করিম সহ অন্নান্য সহজেই আপন করে নিলো। সুসজ্জিত বাংলো থাকার ব্যবস্থা, অফিসার্স মেসে খাবার ব্যবস্থা নাম মাত্র মূল্যে. কাজ হলো কোম্পানির আওতাধীন তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র ( হরিপুর , কৈলাশটিলা , ছাতক ) এবং একমাত্র তেল ক্ষেত্র সিলেট ৭ উৎপাদন ব্যবস্থাপনা। পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে পেট্রোবাংলার অনুসন্ধান এবং খনন কাজে কোম্পানির তরফ থেকে সমন্বয়। তখন সিলেট ৮ কূপ খননের প্রস্তুতি চলছিল। বিয়ানীবাজার এবং কৈলাশটিলায় পেট্রোবাংলার প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট গ্যাস কূপ খনন করছিলো। সহকর্মীরা খুব আন্তরিক থাকায় আমার কাজ বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি।সিলেট গ্যাস ফিল্ডের পুরোনো কর্মকর্তা কর্মচারী পিপিএল সময় থেকে কর্মরত। ১০০% আবাসিক কোম্পানি। সবাই যেন ঘড়ির কাটার মতো চলে।
আমি শুরুতেই তেল কূপ উৎপাদনের ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল করায় মনোযোগী দেই। অপারেশন শৃঙ্খলা ছাড়াও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করি. কয়েকজন অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারী থাকায় আমার গুছিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। এই সময় তেল কূপ দেখতে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রতিদিন অনেক ভিআইপি আসতেন। সিলেট তামাবিল সড়ক সংলগ্ন তেল ক্ষেত্রে পরিদর্শনের জন্য একটি লিখিত নীতিমালা করা হয়েছিল। আমরা অত্যন্ত নির্ভরতার সঙ্গে সেটি পালন করি. উৎপাদন বিষয়ে আমাকে এই সময়ে হাতে কলমে শিখিয়েছিলেন বুয়েট অগ্রজ আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার কাজী শহীদ ভাই. উনি তখন বিজিএফসিএলে কর্মরত ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে ছুটির সময়ে দেশে শেখাতেন। আমরা দুজন মিলে আরো অন্তত দুটি লোকেশনে গ্যাস কূপ খননের পরিকল্পনা করলাম। দেখলাম এবং জানলাম গ্যাস পাবার উদ্দেশ্যে খনন কৃত কূপে অভাবনীয় ভাবে তেল আবিষ্কার হয়। প্রস্তুতি না থাকায় গ্যাস কূপের যন্ত্রপাতি দিয়ে কমপ্লিশন করা হয়। সাধারণত তেল কূপে সাব সারফেস সাফটায় ভালভ প্রয়োজন হয় না। এখানে সেটি লাগানো হয়েছে। আবিষ্কৃত তেল কূপের তেলের সঙ্গে অনেক মোম থাকায় মোম জমা হত সেফটি ভালভের আশেপাশে। ফলে উৎপাদন কমে যেত.শহীদ ভাইয়ের সেখান উপায়ে কয়েকবার মহসিন এবং আমি ওয়ার লাইন ইউনিট ব্যাবহার করে কূপ পরিষ্কার করেছিলাম।এই সময়ে মহসিন ভাই পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) এবং সঙ্গে পরিচালক প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট ছিলেন। উনি আমাকে বিয়ানীবাজার , কৈলাশটিলা এবং রশিদপুর গ্যাস কূপ খনন কাজে পিআইইউ ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে সমন্বয় করার উপদেশ দেন।
আমি মাঝে মাঝে কৈলাশটিলা গ্যাস ক্ষেত্র পরিদর্শন করতাম। তখন দুটি গ্যাস কূপ উৎপাদনে ছিল। কনডেনসেট সমৃদ্ধ গ্যাস ক্ষেত্রে একটি কনডেনসেট পরিশোধন ব্যবস্থা ছিল। পেট্রোল এবং ডিজেল উৎপাদন হতো।তখন কৈলাশটিলা ২ লোকেশনে গ্যাস কূপ খনন এবং এমএসটিই প্লান্ট স্থাপন হয় নি।আমি ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র পরিদর্শন করে কূপটি থেকে গ্যাস উৎপাদন স্থগিত দেখতে পাই। আমার কাজে মহাব্যবস্থাপক অধিকাংশ সময়ে সন্তুষ্ট ছিলেন।
এই সময়ে সিলেট অঞ্চলে তেল অনুসন্ধানের জন্য বিতর্কিত ভাবে সিমিটার নামের একটি ভুঁইফোড় কোম্পানিকে নিয়োগ করায় সিলেট সহ দেশবাসী ফুঁসে উঠে। স্থানীয় পর্যায় এবং জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন শুরু হয়।আমার কাজ ছিল উৎপাদিত তেল নির্বিগ্নে সিলেট রেল স্টেশনে পৌঁছে দেয়া। এই কারণে দেশের স্বার্থে আমাকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হতো। আমি কিন্তু নিজেও আবিষ্কৃত তেল ক্ষেত্র পূর্ণ মূল্যায়ন না করে অস্বচ্ছ উপায়ে একটি বিদেশী কোম্পানিকে ইজারা দেয়া মেনে নিতে পারিনি। সেই সময়ে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ডক্টর কামাল হোসেন , ডক্টর মোশারফ হোসেন , বাংলাদেশ কমুনিস্ট পার্টি , জাসদ (ইনু) গ্রপের কথা মনে আছে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য আমি খেলার মাঠে একটি ক্রিকেট উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলি। কিছু উৎসাহী কর্মচারীকে নিয়ে আমি একটি শক্তিশালী দল গড়ে তুলি। আমি তখন নিয়মিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ক্রীড়া বিষয়ে লিখতাম। সেই সূত্রে ক্রীড়ালেখক সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মহাব্যবস্থাপক মহোদয়ের উৎসাহে একবার সিদ্ধান্ত নিলাম ক্রীড়ালেখক সমিতির ক্রিকেট দলকে সিলেটে আমন্ত্রণ জানাবো। সেই সুবাদে ২০ সদস্যের কৰিলেকক দল তিন দিনের সফরে সিলেট গ্যাস ফিল্ডে আমাদের অতিথি হয়ে আসে।এই দলের সঙ্গে প্রথম এবং মাত্র একবার আমার স্ত্রী রোজি ,শুভ্র এবং অভ্রকে নিয়ে সিলেট এসেছিলো। শ্রদ্ধেয় আতাউল হক মল্লিক ভাইয়ের নেতৃত্বে ওই দলে জিয়া ভাই, সালমা আপা, ফরহাদ টিটো , উৎপল শুভ্র , দুলাল মাহমুদ , নাজমুল কিরণ ছিল. অনেকেই প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া লেখক ,কেউ প্রবাসী , কেউ পরপারে।
আমার নেতৃত্বে গ্যাস ফিল্ড দল শক্তিশালী ক্রীড়া লেখক দলকে ৮ উইকেটে পরাজিত করে. আমি ম্যান অফ টি ম্যাচ হয়েছিলাম। তিন দিনের সফরে দলটি গ্যাস ক্ষেত্র, তেল ক্ষেত্র , জাফলং। তামাবিল সফর করেছিল। ঢাকার কয়েকটি দৈনিকে কিছু লিখেছিল টিটো , শুভ্র।
চলবে।