সালেক সুফী।।
বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরের প্রথম যুগের সকল কিংবদন্তির সঙ্গে ব্যাক্তিগত পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেক্টরের প্রাণপুরুষ ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে বাসায় এবং চেম্বারে অনেকবার গ্যাস সেক্টর প্রজেক্টস নিয়ে আইনি পরামর্শ নিয়েছি। পেট্রোবাংলার প্রথম চেয়ারম্যান উপমহাদেশের শীর্ষ স্থানীয় ভূতত্ত্ববিদ ডক্টর হাবিবুর রহমান ছিলেন বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্টান পিএলটির স্থানীয় প্রধান। কাছে থেকে দেখেছি কাজ করেছি। শুরু থেকে আমার সময়ে শেষ চেয়ারম্যান ওসমানী সাহেব কাজের মাদ্ধমেই আমাকে চিনতেন। দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান মোশাররাফ হোসেনের অধীনে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছি। চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন, টিআইএএস এন খান লোধি, শামসুদ্দিন আহমেদ , মইনুল আহসান, মোমিনুল হক ,এমদাদুল হক , মনজুর মোর্শেদ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ সংযোগে কাজ করেছি। এরা কেউ কখনো বলতে পারবে না কোনো দিন কোনো কাজে বার্থ হয়েছি। হা অনেক ক্ষেত্রে আমার সম্পাদিত কাজের কৃতিত্ব হাইজ্যাক হয়েছে। কিন্তু কোনো স্বীকৃতি বা অর্জনের জন্য কাজ করিনি। দেশীয় কোম্পানি ম্যাক্সওয়েলকে অযাচিত ভাবে চুক্তির লঙ্ঘন ঘটিয়ে যখন চুক্তি টার্মিনেট করে পারফর্ম করা প্রকল্পে পারফরমেন্স গ্যারান্টী জব্দ করা হয় সরকারি আদেশে আরবিট্রেশনে অংশ নিতে গিয়েছি। এমনি ভাবে যখন স্থানীয় কিছু ঠিকাদাররা সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধু ব্রিজ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে ডাকাতি করেছে তদন্ত কমিটিতে সত্য কথা বলেছি। এগুলো কাজ কোনো দেশপ্রেমিককে দেশদ্রোহীর কালিমা এনে দিতে পারে না।আমি যত ছোট চাকুরে হই ন্যাকা কেন সম্পৃক্ত থাকলে গ্যাস সেক্টরের এতো দৈন্য দশা হতো না। আমি নিজে হাতে অনেক প্রভাব শালী মহলের অবৈধ গ্যাস সংযোগ কেটে দিয়েছি, কনডেনসেট পাইপ লাইনের চুরি বন্ধ করেছি। আমার সময়ে জিটিসিএল অপারেশন বিভাগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্কাডা প্রকল্পটি আমার হাতেই অপারেশনাল হয়েছিল। আমি চলে আসার পর বাংলাদেশে কোনো বড় গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় নি, জিটিসিএলকে একের পর এক অপ্রোজনীয় বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে পঙ্গু করা হয়েছে। লক্ষ্ লক্ষ অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন গ্যাস মাফিয়াদের চারণ ভূমি।
বিজিএসএল ধারাবাহিক
জন বাকলি শীতলপুর থেকে শুভপুর ফেনী নদীর পাড় পর্যন্ত ৪৪ কিলোমিটার পাইপলাইন শেষ হওয়ার পর ক্লিনিং পিগ্গিং পরিকল্পনা করে। একে একে তিন তিনটি পিগ চালনার পরেও পিগ শুভপুর না পৌঁছানোয় একদিন ওই সময়ে বিজিএসল মাঠ পর্যায়ে পিগ্গিং অভিজ্ঞ আমার সঙ্গে আলাপ করে. সে নিজ উদ্যোগে একটি নকিং পিগ ফ্যাব্রিকেট করে দুদিন ক্রমাগত পাইপ লিনের উপর হেটে মিরেরসরাই একটি সাথে তিনটি পিগ একসঙ্গে স্পট করে।পাইপ কেটে দেখা চায় প্রথম পিগের পিগ সিগন্যাল ভেঙে উল্টো হয়ে যাওয়ায় পিগ গুলো আটকে পড়েছিল। ফেনী নদী ক্রসিংয়ের দিন আমার ছেলে শুভ্রর প্রথম জন্ম বার্ষিকী ছিল। শুনে অবাক হবেন মহসিন ভাইয়ের মনে ছিল। কাজ শেষে আমাকে নিয়ে উনি কম্মিল আসেন এবং আমার বাসায় ক্ষুদ্র আয়োজনে যোগদান করে শুভ্রকে দোআ করেন।
ফেনী নদী ক্রসিংয়ের সময় আমার সঙ্গে গ্রামবাসীর অনেক হৃদ্যতা হয়েছিল। এই সময় মাঝে আমার শিশু সন্তান শুভ্রকে আমার গাড়ির চালক কম্মিল্লা থেকে নিয়ে আসতো। একবছরের শিশু সারা দিন কাজের স্থানে থাকতো। এমনকি backhoe অপেরেটর ,Sideboom অপেরাটরা ওকে বসিয়ে কাজ করতো। একই পদ্ধতিতে মুহুরী নদী ক্রসিং হয়। শেষ দিনে বিশেষ অনুরোধে আমার স্ত্রী এই প্রথম এবং শেষবার আমার পাশে শুভ্রকে নিয়ে উপস্থিত ছিল। মনে আছে স্থানীয় গ্রামবাসী ওদের অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল।
লেমুয়ায় কালিদাস পাহাড়িয়া নদী ক্রসিংয়ে মূল বাধা ছিল লেমুয়া সেতু। নদী বক্ষে খননের জন্য ড্রেজার আনার সুবিধার্তে সেতুটি চার সপ্তাহের জন্য ভাঙার অনুমতি নেয়া হয়েছিল। এইসব কাজে স্থানীয় কর্নেল এনাম অনেক কুশলী ছিলেন।
ফেনী অঞ্চলে ফাজিলপুর এবং পাঁচগাছিয়া থেকে ডাকাতিয়া নদী পর্যন্ত কাজ করার সময় মূল চ্যালেঞ্জ ছিল স্থানীয় প্রভাবশালী জয়নাল হাজারীকে নিউট্রাল রাখা। সেই কাজটি ঠিকাদার ভালোমত সামাল দেয়। স্বীকার করতেই হবে জয়নাল হাজারী আমাদের যথেষ্ট সহায়তা করেছেন। গুণবতীতে তিন তিনটি ফেব্রিকেটেড ভালভ স্টেশন রেল ফ্লাট বডিতে পরিবহনের কথা আগেই বলেছি। ইতিমধ্যে বর্ষায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। আমরা ভরা বর্ষায় ডাকাতিয়া নদীর দুইপাড় দ্বীপ বানিয়ে বটম পুল পদ্ধতিতে ফেনী ক্রস করি। এই সময় বহুবার আমি স্পীড বোট চালিয়ে সাইট পরিদর্শন করেছি। জন বাকলির সঙ্গে সমযোতা করে গুণবতী রেল ক্রসিংয়ের একটি নাছোড়বান্দা চেষ্টা নিয়েছিলাম। কিন্তু জুলাই মাসের ভারী বর্ষণ বাদ সাধে। সেই থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত অস্থির ছিলাম কখন ফায়ার যাবো গুণবতী। মহসিন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ১৯৮৩ বিজয় দিবসে গ্যাস পৌঁছাবে চট্টগ্রাম। জুলাই আগস্টের মাঝে আবেদিনের আওতায় থাকা ফ্রন্ট এন্ড কুমিল্লা অঞ্চলের অধিকাংশ কাজ শেষ করে ফেলেছিলো। আমার একটি crew লাকসাম বরুড়া অঞ্চলের কাজ শেষ করে কুটুম্বপুর পৌঁছেছিল। মনে আছে নভেম্বরের শেষ দিকে ফায়ার গেলাম গুণবতী কাজে সঙ্গে ছায়ার মতো সানোয়ার ,শফিক। অনেক কাজ গুণবতী রেল ক্রসিং ,তিনটিনটি ভালাভে সংযোগ এবং রেল লাইনের কুমিল্লা প্রান্তে এককিলোমিটার নিম্নাঞ্চলে অসমাপ্ত কিছু কাজ।আমি কর্নেল আমাকে জানালাম আমি কাজ না শেষ হয় পর্যন্ত গুণবতী রেল লাইনের ঢালে তাবু গেড়ে থাকবো। সানোয়ার ,শফিক প্রস্তুত। আমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই মেজর এহ্সানুল্লাহ , দোস্ত ভাই এসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তর্পন করতো। জন বাকলে আমাকে বন্ধু হিসাবে নিয়েছিল। আমরা দেখলাম জমি শুস্ক হতে জানুয়ারী পেরিয়ে যাবে। একমাত্র উপায় উজানে সুইস গেট বন্ধ রেখে জলশেজ অন্তত একমাস পিছিয়ে দেয়া। মহসিন ভাই তার ফৌজিয়ান বন্ধু ব্রিগেডিয়ার রাব্বানীর ( নোয়াখালীর মার্শাল ল এডমিনিসট্রেটর) সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। কর্নেল এনাম বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এবং ফেনী জেলা প্রশ্নের সঙ্গে সমন্বয় করলেন। সিদ্ধান্ত হলো নভেম্বর ২০ থেকে ডিসেম্বর ২০ সময় সুইস গেট বন্ধ থাকবে।
কাজগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পেরেছিলাম জন বাকলে crew অসামান্য পেশাদারিত্ব, নিজেদের দেশপ্রেম ,খুদে ইঞ্জিনিয়ার সনাওয়ার চৌধুরীর কিছু উদ্ভাবনী চিন্তার কারণে। ডিসেম্বর মাশাহের ১২ তারিখ সকালে আমরা গুণবতী রেল ক্রসিং শেষ করি. কুমিল্লা থেকে ছুতে আসেন অধীর আগ্রহে সাফল্য বার্তা শুনার জন্য অপেক্ষারত মহসিন ভাই. নিশ্চিত হয়ে পরে বাখরাবাদ পাইপলাইন শেষ হওয়া। পাইপ লাইন নির্মাণ সম্পাদনে গুণবতী এলাকা স্মরণীয় মাইল ফলক হয়ে থাকবে। দুইদিনের মাঝে এই এলাকার বাকি সব কাজ শেষ হয়।ফৌজদারহাত থেকে ডাকাতিয়া নদী পর্যন্ত অংশ আগে থেকেই হাইড্রোটেসট সম্পাদিত হয়েছিল। ওপর অংশের টেস্ট শেষ হলো ১৫ ডিসেম্বর। বাকি অংশের ফাইনাল টাই ইন এবং পাইপলাইন কমিশনিং।
চলবে।