সালেক সুফী।।
২৮ বছর দেশে এবং ১৮ বছর প্রবাসে কর্ম জীবনে কতনা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ গুলো ছিল ভিন্ন। আমাদের সময়ে সম্পাদিত গ্যাস সেক্টরের সকল চ্যালেঞ্জিং কাজের কাছে থাকার সুযোগ পাওয়ায় আমি বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ। আজ আমি বাখরাবাদ- চট্টগ্রাম সঞ্চালন পাইপলাইন এবং চট্টগ্রাম রিং মেইন প্রকল্পের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য অংশের সক্ষিপ্ত বৰ্ণা দিবো নবীন প্রকৌশলীদের অনেক কিছুই শিক্ষার আছে।
আমরা শিখেছি। নির্ভেজাল ইতিহাস জানারও প্রয়োজন। নাহয় কিছু বছর পর সব স্মৃতি বিস্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যাবে। কেউ কেউ নিজেদের হিরো দাবি করবে। বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা ইন্ডাস্ট্রির সংযোগ বিহীন থাকায় লেখা পড়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বাস্তব কাজ। অনেকেই তাই চাকুরী জীবনের শুরুতে চাপে পরে। যাদের সহন শীলতা থাকে শিখার আগ্রহ থাকে তারা পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশেষজ্ঞ হিসাবে।
আমার সৌভাগ্য চাকুরী জীবনে চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন, মাহমুদ রশিদ , শামসুদ্দিন আহমেদের মতো গুরুজন পেয়েছি। তাদের স্নেহ ,শাসন আমাকে সৎ আত্মবিশ্বাসী কিছু মানুষের মতে দেশদ্রোহী (?) বানিয়েছে। তবে দূরদেশে থেকেও ভালো লাগে যখন অনুভব করি আমাদের ঘাম শ্রমের বিনিময়ে সাভার মানিকগঞ্জ এলাকায় মানুষ গ্যাস পাচ্ছে, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো ,সরকারখানায় গ্যাস ব্যাবহৃত হচ্ছে , চট্টগ্রাম সহ সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশে গ্যাস বিতরণে কিছু ভূমিকা আছে. নাই বা পেলাম জাগতিক স্বীকৃতি বিধাতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন দিয়ে চলেছেন।
বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম সঞ্চালন পাইপ লাইনের কাজের সমান্তরালে ইটাল মোন্তাজি চট্টগ্রাম বেষ্টনী পাইপলাইন নির্মাণ করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের একপর্যায়ে মুঈনুল আহসানকল্প সমন্বয়কারীর দায়িত্বে চট্টগ্রাম অফিসে যোগদান করেন। উনি সঞ্চালন পাইপলাইন কাজে খুব একটা সম্পৃক্ত ছিলেন না. মূলত চট্টগ্রাম কার্যালয়ে অবস্থান করে উনি গুলজার হোসেন আলমগীরের মাদ্ধমে রিং মেইন এবং আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (মিন্টু ) এবং সাইফুল আলম চৌধুরীর মাদ্ধমে রিং মেইন থেকে কাপ্তাই পেপার মিলল পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ কাজ দেখা শুনা করেন। শাহাদাৎ আলী ফৌজদারহাট সিটি গেট স্টেশন এবং পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদী HDD ক্রসিং কাজের দায়িত্বে ছিলেন। ভদ্র লোক ভালো ব্যাবস্থাপক হলেও শুরুতে পাইপ লাইন কাজে অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাঁর সাথে বিজিএসএল এবং জিটিসিএলে পরবর্তীতে দীর্ঘদিন কাজ করেছি।
Ring Main হলো চট্টগ্রাম শহরের গ্যাস বিতরণ কাজ সুষম ভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ৩৫০ পিএসআই চাপে পরিচালিত একটি মদ্ধম চাপ পাইপলাইন। ফৌজদার হাট সিটি গেট স্টেশন থেকে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাস হয়ে কালুরঘাট বিএফ এই ডিসি পর্যন্ত ২৪ ইঞ্চি বাসের ইস্টার্ন লেগ। এর পর কালুরঘাটে ২০ ইঞ্চি বাসের উন্মুক্ত পদ্ধতির রিভার ক্রসিং সহ কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ২০”/১৬” ম্যানিফোল্ড পর্যন্ত ২০” বাসের পাইপলাইন।
অন্যদিকে ফৌজদার হাট সিজিএস থেকে হালিশহর ,ইপিজেড হয়ে পতেঙ্গা উত্তর পর্যন্ত ২৪” বাসের ইস্টটার্ন লেগ। সেখান থেকে ১৬” বাসের ১ কিলোমিটার HDD ক্রসিং সহ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ১৬”/২০” ম্যানিফোল্ড। অন্য সবার মতো প্রকল্প পরামর্শকদের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল কেন পুরো পাইপলাইন ২৪” বা ২০” বাসের হলো না। কারণ ছিল কর্ণফুলী নদীর সাগর মোহনায় জাহাজ চলাচল বিঘ্ন ঘটিয়ে কোনো ভাবেই ওপেন কাট নদী ক্রসিং বাস্তব সম্মত ছিল না।১৯৮০ দশকের শুরুতে Reading & Bates একমাত্র HDD পদ্ধতিতে রিভার ক্রসিং করতো। আর ওই সময় পর্যন্ত ৯০০-১০০০ মিটার দীর্ঘ ক্রসিং ১৬ইঞ্চির বড় পাইপলাইন নির্মাণের টেকনোলজি ছিল না। আর তাই সুষম প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ২৪”/২০” /১৬” পাইপ লাইন সমন্বিত করে রিং মেইন ডিজাইন করা হয়।মূল পাইপলাইন নির্মাণ কাজ ইটাল মোন্তাজির থাকলেও HDD ক্রসিং কাজ করে Reading & Bates এবং ঝুঁকি নিয়ে কালুরঘাটে ওপেন কাট ক্রসিংয়ের কাজ দেয়া হয় স্থানীয় ঠিকাদার ম্যাক্সওয়েল গ্রুপকে।
শাহাদাৎ ভাইয়ের আমন্ত্রণে একদিন HDD ক্রসিং কাজ পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। অসাধারণ পেশাধারী দক্ষতায় মাত্র ২৭ দিনে পুরো কাজ সম্পাদন করেছিল ঠিকাদার। মার্কিন কোম্পানির কাজ করার সময় গুপচর বৃত্তির চেষ্টা করেছিল আরেকটি বড় দেশ. ভাবতে অবাক লাগে তিন দশকে HDD ক্রসিং টেকনোলজি কত বিস্তৃত হয়েছে। ২০১৮ পাশাপাশি জিটিসিএলের ভারতীয় ঠিকাদার ৪২ ” ক্রসিং করেছে। আমার নিজের সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকটি ৩০” HDD ক্রসিং কাজ তদারকির। অস্ট্রেলিয়ায় আমি ৫৬ ইঞ্চি ক্রসিং থেকেছি।
পতেঙ্গায় কর্ণফুলী ক্রসিং অনায়েসে শেষ হলেও কালুরঘাটে ক্রসিং সংকটে পড়েছিল। একদিন হটাৎ ডেকে পাঠালেন কালুরঘাটে। ওই দিন ওপেন পদ্ধতিতে ২০ ইঞ্চি বাসের ক্রসিংয়ের পাইপলাইন সারফেস পুল হবে। আমরা জাহাজ থেকে উইঞ্চ দিয়ে পুল করা মহসিন ভাই সহ তদারকি করছি। নদীতে প্রচন্ড জোয়ার। ভাসমান পাইপলাইন ধরে রাখার জন্য স্বভাৱবো সকল ক্ষেত্র থেকে ভাসমান ক্রেন জোগাড় করেও পাইপলাইন ভেসে যাওয়ার জোগাড়। এখানেও যুদ্ধক্ষেত্রের বিজয়ী কমান্ডারের ভূমিকায় চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন। সারা রাতের নির্ঘুম প্রচেষ্টায় সুবহে সাদেক নাগাদ কাজ শেষ।আমি আগেই বলেছি আমি অনেক যুদ্ধ মাঠে যুদ্ধ কমান্ডার বিচলিত হতে দেখেছি কিন্তু মহসিন ভাইকে দেখেছি কঠিন সময়েও অটল হিমাদ্রির মতো কাজটি সফল না হলে অনেক অসুবিধা হতো স্থানীয় নির্মাণ ঠিকাদার এবং আমাদের।
কর্ণফুলী ক্রসিং শেষে মহসিন ভাই সহ আমি সীতাকুন্ড ক্যাম্পে কিছুক্ষন অবস্থান করে ফেনী ফায়ার যাই। মহসিন ভাই ঢাকায় মিটিং থাকায় কুমিল্লা হয়ে ঢাকায় চলে যান।
সঞ্চালন পাইপ লাইনের টেস্টিং কমিশনের জন্য পাকিস্তানের সুই গ্যাস থেকে আসলাম শের খানকে আনা হয়েছিল। এই প্রথম কষ্ট পেলাম। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনায় যেভাবে যুদ্ধ জয়ের নেশায় ছিলাম পাকিস্তানী বিশেষজ্ঞ তত্ত্বাবধায়ক হয়ে আশায় কিছুটা খারাপ লেগেছিলো। বিজ্ঞ পাকিস্তানী প্রথম আলাপে আমাদের মনের ভাব অনুধাবন করতে পারে। বলেছিলেন। You guys are champions , you will get the works done . I will be with you watching .”
অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং প্রাণবন্ত ৭২ ঘন্টার কমিশনিং পর্বর জন্য অপেক্ষায় থাকুন। স্মৃতির কেসেট রিওয়াইন্ড করছি। টরোন্টোতে শাহাদাৎ ভাই ,ঢাকায় সানোয়ার চৌধুরীর সাথে কথা বলবো। শফিক আজিজ ,তোফাজ্জেল , গুলজার ভাই, মেজর এহ্সানুল্লার কথা মনে পড়ছে। আজিজ ,গুলজার ভাই, শফিক পরপারে। এমাসেই ৭০ বছরের বুড়ো হবো। কত স্মৃতি ধরে রাখা যায়?
চলবে।