সালেক সুফী।।
যারা আমাকে দেশদ্রোহী খেতাব দিয়ে পেশাদার জীবনের সেরা সময়ে দেশের হয়ে কাজ করার সুযোগ বঞ্চিত করেছে তাদের বলি বাংলাদেশের গ্যাস সেক্টরে আমার অংশগ্রহণে সম্পদিত অনেক মাইলফলক আছে. হয়তো আমাকে বঞ্চিত করা না হলে বাংলাদেশ গ্যাস সেক্টরে আরো কিছু উপমধর্মী অবদান রাখতে পারতাম। আমি বাখরাবাদ থেকে কাপ্তাই , বিয়ানীবাজার থেকে বগুড়া সব উচ্চ চাপ পাইপ লাইন ,আনুষাঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ এবং পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছি। একসময় সমগ্র উচ্চচাপ গ্যাস পাইপলাইন পরিচালনা করেছি। গ্যাস সিস্টেমে স্কাডা স্থাপন এবং চালু করেছি, ইউনোকোল ,শেভ্রন ,কেয়ার্নের কাজে পেট্রোবাংলা প্রতিনিধি ছিলাম। এগুলো কি একজীবনে কোনো দেশদ্রোহী করতে পারে? বিবেচনার ভার পাঠকদের কাছেই দিলাম.২০০৫ আমাকে বিদায় দেয়ার পর কেন গ্যাস সেক্টর পিছিয়ে পড়লো দেশ প্রেমিকদের নিয়ে?
তিতাসে শেষ অধ্যায়।
তিতাস গ্যাস যখন ১৯৭৯-৮০ হবিগঞ্জ আশুগঞ্জ গ্যাস ক্রস কান্ট্রি গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় তখন কোম্পানির পাইপ লাইন নির্মাণ বিভাগ থেকে সিনিয়র অধিকাংশ প্রকৌশুলি ইরাক , লিবিয়া চলে গাছে। তবুও সাহসী ব্যাবস্থাপক মাহমুদ রশিদ আমাদের মতো স্বল্প অভিজ্ঞ প্রকৌশুলি জাহির আমি, জামাল ,মিন্টুদের উপর আস্থা রেখে হিসেবি ঝুঁকি গ্রহণ করেন। আমাদের চাকুরী জীবনের বিশাল অর্জনের সাথী ছিল খালিদ ভাই , কাদের ভাই এবং হেকমত খোদা , নিজাম ,নুরুদের মতো দুরন্ত দল। শেষ দিকে আতিক ,ক্রিকেটার মঞ্জ আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো। হবিগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্লাবন ভূমির নিম্ন এলাকায় ক্রস কান্ট্রি পাইপলাইন সময়ের আগে শেষ করে এই দলটির সাফল্য ছিল উপমধর্মী।
আগেই বলেছি আমার ব্যাবস্থাপনায় ছিল হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পশ্চিম পাড় পর্যন্ত নিচু নদী বিল এলাকা। ১৯৭৯-৮০ আমি বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেট দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলতাম, ক্রীড়াঙ্গনে লেখালিখির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলাম। বন্ধু সহপাঠী ,সহকর্মী মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে ঠুনকো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্যের পর অগ্রজ ক্রিকেটার বন্ধু রকিবুল হাসানের সঙ্গে মালিবাগ চৌধুরী পারে থাকতাম। অফিস সময় ছাড়া বাকি সময় স্টেডিয়াম পাড়ায় বিশেষত ইসলামিয়া রেস্টুরেন্ট , মোহামেডান তাঁবুতেই সময় কাটতো। নাটক ,সংস্কৃতি অঙ্গনে যাতায়াত ছিল। ক্রীড়া পরিবারের প্রথম যুগের সবার সঙ্গে ছিল আত্মার আলিঙ্গন। ছিলাম ক্রীড়ালেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা স্টেডিয়ামে তৎকালীন ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের পাশের অফিসটি ছিল আমাদের। ক্রীড়াজগৎ/স্পোর্টসওয়ার্ল্ড পত্রিকার ভোরের পাখি ছিলাম। বিচিত্রা , ৰোৱাবৰ সোহো সাময়িকী এবং অধিকাংশ দৈনিকে নিয়মিত প্রচুর লিখতাম বাংলা ইংরেজি দুই ভাষায়। চৌকষ তরুণ হিসাবে তরুণীদের কাছেও ছিলাম আকর্ষণীয়। এমনি একজন মানুষ সবকিছু ছেড়ে ঢাকার বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘাঁটি গাড়বে সেটি আমার বন্ধুদের কাছে অকল্পনীয়। একজন দেশদ্রোহীর জন্য আরো প্রণিধানযোগ্য না। আমার মা এবং বোনেরা তখন আমাকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন।
যখন কাজ শুরু হলো বর্ষা সমাগত। আমার অধীনে অংশ সম্পূর্ণ পানিতে ডুবে আছে. ওদিকে আবার প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করে ঢাকা ফিরে যাবার তারা। এছাড়া যথাসময়ে শেষের অপেক্ষায় থাকবে নির্মাণের শেষ পর্যায়ে থাকবে আশুগঞ্জ ( জিয়া সারকারখানা )।আমার অংশের ঠিকাদার অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিল।আমাকে অগ্রণীর ভূমিকা নিতে হলো।শুরুতেই আমাদের দুর্বল ওয়েল্ডারদের নতুন ইলেক্ট্রোড এবং নতুন লাইন পাইপ স্টিলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিলো। খালিদ ভাই আমাকে অনেক সহায়তা করেছেন। আমার টিমে নিজাম ,নুরুর মত সৃজনশীল দুইজন নিবেদিত সহকর্মী ছিল. শুরুতেই কিছু ব্যাতিক্রমী সৃজনশীল কাজ করলাম। আর্কিমিডিসের প্লাববতা সূত্র অনুযায়ী ১২” বাসের লাইন পাইপ পানিতে ভাষার কথা। আমি নুরুর উদ্ভাবনা চিন্তার সঙ্গে সহমত হয়ে সিদ্দান্ত নিলাম ১০-১২ করে লাইন পাইপ সড়ক পাশে রেকডিং করে ,রেডিওগ্রাফির পর প্রান্ত সীল করে ভাসিয়ে রাইট অফ ওয়ে নিয়ে যাবো সড়ক পাশে কোল টার এনামেল কোটিং করে. . যেই ভাবা সেই কাজ। এই কাজে বর্ষার মাঝে আমার অংশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ মাধবপুর থেকে লোহাড় নদী পর্যন্ত পাইপলাইন রাইট অফ এ পৌঁছে গেলো। জমির মালিকরা কিছু বোঝার আগেই তাদের জমিতে গ্যাস পাইপলাইন ভেসে থাকলো। এমনকি লাগসই পদ্ধতি অবলম্বন করে নৌকায় ওয়েল্ডিং মেশিন চড়িয়ে পাইপ লাইন অংশগুলো পানির উপর জোড়া দিয়েছিলাম ভোরে যায়। এই বুদ্ধিটি আমাকে দিয়েছিলো সহকর্মী নুরু। এভাবে বর্ষার আগেই আমার পাইপ লিনের ৬০% প্ৰস্তুত হয়েছিল। মনে আছে তৎকালীন জ্বালানি মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আকবর হোসেন পরিদর্শনে এসে আমাদের খুব প্রশংসা করেছিলেন। কাজটা খুব সহজ ছিল না। আগেই বলেছি আমার অংশের ঠিকাদার দুর্বল ছিল।আমাকে রাখালের ভূমিকা নিতে হয়েছিল।
আরো কয়েকটি বিশেষ উদ্ভাবনী লাগসই সযোজ্ঞন ছিল এই পাইপে লাইন। সেগুলোও এসেছিলো সহকর্মী নুরুর কাছ থেকে। ফসল কাটার পর ধানের মাঠে রাতে ওয়েল্ডিং করার সময় পোকার উৎপাত ছিল। আমরা এলিফ্যান্ট টেন্টের উপর বিশেষ ভাবে নির্মিত মশারী টানিয়ে পোকার হাত থেকে ওয়েল্ডারদের সস্থি দিয়েছিলাম। পথের পাশে বিটুমিন গলিয়ে পাইপ কোটিং রাপিং করাও ছিল নুরুর সংযোজন।
আমার অংশে তিনটি নদী ছিল সোনাই ,লোহার ,মধ্য গঙ্গা। সাধারণ সময়ে শুকিয়ে গেলেও বর্ষার সময় পাহাড়ি নদীগুলো ছিল খরস্রোতা। স্মরণে রাখুন তখন কিন্তু এইচডিডি দূরের কথা এক্সকাভেটর বা ড্র্যাগলাইন ছিল না. লোহার ,সোনায় ক্রসিং অসুবিহা হয় নি। কিন্তু সমস্যা হয় মধ্য গঙ্গা নিয়ে। ঠিকাদার যত মাটি কাটে পরদিন সাব সারফেস পানির তোড়ে আবার ভরে যায়। মনটা ঢাকায় ফেরার জন্য অস্থির। আমাদের অতিথি ভবনের পাশেই ছিল রাজনৈতিক নেতা মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল হুদা ভাইয়ের বাসা। সেই বাসায় কয়েকজন সুন্দরী তরুণীর একজনকে মনে ধরলো যদিও ঢাকায় একজনের সঙ্গে মন দেয়া নেয়ার প্রথম পর্ব চলছিল। প্রথম পরিচয়ে মেয়েটির সাফ কথা প্রেম ট্রেম বুঝিনা পারলে বিয়ে করে সঙ্গী করুন। কাকতলীয় বিষয় হলো যে দিন পরিচয় সেদিন রাত কাজ করে নদী ক্রসিং শেষ হলো।মনে আছে স্থানীয়দের পরামর্শে রাতে কাজের সময় নদীর একপাশে কোরান তেলোয়াত অন্য পাশে মনসা পূজার ব্যবস্থা করিয়ে ছিলাম ঠিকাদারকে দিয়ে।
আমার প্রেম বিয়ে নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। আমার পরিবার বসেছিল। কিন্তু আমার তিতাস সহকর্মী, ক্রীড়াঙ্গনের বন্ধুরা পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের প্রথম দিকের ফুলের বিয়ে ছিল আমাদের। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ আমার বোহেমিয়ান জীবনকে ঝর্ণাধারার সাচ্ছন্দ দিতে পারতো কিনা সন্দেহ। রোজি আমার জীবনের আশীর্বাদ। ওকে সঙ্গী করে শুভ্র ,অভ্র আর দুই নাতি নাতনিকে নিয়ে প্রবাসে সুখী আছি।
যাহোক যথা সময়ে পাইপ লাইনের তিন অংশ শেষে যথা সময়ে চালু হলো গ্যাস সরবরাহ। ফিরে আসলাম ঢাকায়। কিছু দিন পরেই বিয়ে করে সংসার পাতলাম।
চলবে।