কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে অস্থির হয়ে ওঠে পুরোদেশ। পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সরকার। ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি। এতে সরকারি অফিস-আদালতের পাশাপাশি বন্ধ থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ সময়ে ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ব্যাংকিং খাত। এমন পরিস্থিতিতে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তা নেমে এসেছে অর্ধেকে। এটা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা। চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে এসেছিল ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর ১৯ থেকে ২৪শে জুলাই ৬ দিনে এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা একদিনের আয়ের চেয়েও কম।

এ ছাড়া ২১ থেকে ২৭শে জুলাই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

ব্যাংকাররা বলছেন, ইন্টারনেট না থাকায় বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেশের ব্যাংকিং খাত। প্রবাসীরা তাদের আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে পারেনি। তাদের আশঙ্কা, রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ হুন্ডিতে চলে যেতে পারে। যদিও বিশ্লেষকদের দাবি, নানা ধরনের প্রোপাগাণ্ডায় কমতে পারে প্রবাসী আয়।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুলাই মাসে ২৭ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৩ দিনে আসে ৯৭ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং ১৪ থেকে ২০শে জুলাই ৭ দিনে আসে ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর পরের সপ্তাহ অর্থাৎ ২১ থেকে ২৭শে জুলাই তা নেমে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ডলারে। এর আগে প্রথম ২৪ দিনে ১৫০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। জুলাই মাসের প্রথম ১৮ দিনে দেশে দৈনিক রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তবে এই ধারাবাহিকতার পতন হয়েছে ১৯ থেকে ২৪শে জুলাই পর্যন্ত। 

হিসাব অনুযায়ী জুলাইয়ের ২৭ দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রবাসী আয় এসেছে ৫ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৪ ডলার। এটি আগের মাস জুনের চেয়ে কম। জুনে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ওই মাসে প্রতিদিন প্রবাসী আয় ছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ ২১ হাজার ৬৬৬ ডলার।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রবাসীরা ১৯৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান, এ বছর যার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলা সহিংসতার কারণে গত ১৯ থেকে ২৪শে জুলাই ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হয়, এই সময়ের মধ্যে মাত্র একদিন ব্যাংক খোলা ছিল। এরইমধ্যে দেশের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে ১৯ই জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। আবার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। ২৪শে জুলাই সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খোলা হয়। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ফলে প্রবাসীরা কোনো রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি। এরই প্রভাব পড়ে পুরো মাসের প্রবাসী আয়ে।

প্রবাসীরা এক ডলারের বিপরীতে ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে প্রণোদনা পান ২.৫০ শতাংশ হারে। দেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে ধীরে ধীরে আরও অবনতি হচ্ছে। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে প্রবাসীদের মধ্যে ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ এর ব্যাপক প্রচারণা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচার গুলিতে কয়েকশ’ নিরীহ মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশে রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণা শুরু হয়েছে। এতে সরকারের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গত সপ্তাহে দেশে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার ঘটনা এই আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতির সম্ভাব্য ভয়াবহতা টের পেয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও। এরই মধ্যে ক্ষতি এড়ানোর উপায় ভাবতে শুরু করেছে তারা। প্রথম পর্যায়ে দেশের সব ব্যাংকে বর্তমানের চেয়ে কিছুটা বেশি দামে প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার কেনার নির্দেশ দিয়েছে।

জানা গেছে, রোববার (২৮শে জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকর পক্ষ থেকে কয়েকটি ব্যাংককে মৌখিকভাবে বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার কেনার এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী করে তোলা। সূত্রমতে, বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করে এমন ১২টির মতো বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) এ নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর পর ব্যাংকগুলোতে ডলার রেট সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা হলেও রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক রেমিট্যান্স কেনার রেট ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা ৭০ পয়সা অফার করছে।

দেশে চলমান কারফিউয়ের মাঝে গত বুধবার থেকে সীমিত সময়ের জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয়েছে। টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকার পর ব্যাংকিং কার্যক্রম ফের চালু হওয়ায় মাসের শেষ দিনগুলোতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের একটা অংশের প্রচারণা তারা তাদের রেমিট্যান্স বৈধ পথে পাঠাবেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে গত সপ্তাহে রেমিট্যান্স কম এসেছে। এটা টেম্পোরারি (স্বল্পমেয়াদি)। এখন কম আসছে বলে ভবিষ্যতেও কমবে, তা বলা যাবে না।