অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে সংকটে পড়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। বর্তমানে ক্রাইসিস আরও নিম্নগামী হওয়ায় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, ৫ হাজার টাকার চেক দিলে ব্যাংকটির একটি শাখাও গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না। কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ হচ্ছে ধাপে ধাপে। সবমিলিয়ে নগদ টাকার সংকটে নতুন ঋণ বিতরণও বন্ধ। টানা লোকসান, মূলধন ঘাটতি ও উচ্চ খেলাপি ঋণে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকটি। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ ধারও করতে পারছে না পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও রাজধানীর বিভিন্ন শাখা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

খেলাপিতে হাবুডুবু: বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক যে, তাদের এমন কোনো সিকিউরিটিজ নেই, যার বিপরীতে অন্য ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারবে। নানা অব্যবস্থাপনায় বিতরণ করা ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না। খেলাপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাংকটি।

কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসানে আছে এবং ২০২৩ সালে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এমনকি লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। সর্বশেষ পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের তালিকায় ছিল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু এটা এখন অতীত। এর আগে গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি রোধ ও কার্যক্রম তদারকি করতে ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতেও অবশ্য রক্ষা হয়নি। দিনের পর দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে ব্যাংকটি।

ঘুরে দাঁড়াতে নাম পরিবর্তন: শুরুটা ‘আল-বারাকাহ্‌ ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ দিয়ে। এরপর ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’, এখন তা ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ নামে পরিচিত। সূত্র মতে, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও সৌদি আরবের দাল্লাহ আল-বারাকাহ্‌ গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে ১৯৮৭ সালের ২০শে মে দেশে কার্যক্রম শুরু করেছিল আল-বারাকাহ্‌ ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে নাম দেয়া হয় ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’। মালিকানা হস্তান্তরের পর ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ব্যাংকটিতে। ভুয়া নথি আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৎকালীন উদ্যোক্তারা হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। চলে নজিরবিহীন লুটপাট। ফলে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ ও পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ওরিয়েন্টাল ব্যাংককে পুরোপুরি অধিগ্রহণ করে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শৃঙ্খলা ফেরাতে সেখানে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে পুনর্গঠন করতে হয় ব্যাংকটি। ২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস আইসিবি গ্রুপের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেন দুজন দরদাতা। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নয়াপল্টন শাখার ভিআইপি শাখায় দেখা যায়, নিজের অ্যাকাউন্টের টাকা উঠাতে ব্যাংকের ম্যানেজারের পেছনে পেছনে ঘুরছেন ভুক্তভোগী আমানতকারী জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ব্যাংকের ভল্টে টাকা নেই, তাই ম্যানেজার কেবল আশ্বাসই দিচ্ছেন। গত ঈদের আগে এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আসে। ব্যাংক থেকে আজ-কাল বলে শুধু ঘুরাচ্ছে। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না। এমনকি ৫ হাজার টাকা চাইলাম সেটাও দিতে পারলো না। তিনি বলেন, ফকিরাপুলে আমার একটা ছাপাখানা আছে। কয়েকজন কর্মচারী আছে। অথচ তাদের বেতন দিতে পারছি না। জাকির ৭ বছর ধরে লেনদেন করেন। আছি খুব বিপদে। এগুলো কি বাংলাদেশ ব্যাংক  দেখে না। সরকার কী করে? এটা কোন ধরনের কথা নিজের টাকা তুলতে পারছি না। 

আক্ষেপ করে আরেক গ্রাহক গোলাম মোস্তফা বলেন, ১০ বছর ধরে আমার অ্যাকাউন্ট এই ব্যাংকে। কুমিল্লা থেকে ৪ লাখ টাকা পাঠিয়েছে এক ক্লায়েন্ট। তাকে বললাম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা না পাঠাতে। কিন্তু সে টাকা পাঠিয়ে আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছে। বলেন, ৫০ হাজার টাকা তুলতে এসেছি। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না। 

শুধু জাকির বা মোস্তফা নয় এই শাখাটিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যতজন গ্রাহক এসেছেন তাদের কাউকেই কোনো টাকা দিতে পারেনি ব্যাংকটি। গ্রাহকদের অভিযোগ গত এক মাস ধরে ব্যাংকে ঘুরাঘুরি করেও তুলতে পারছেন না কোনো টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন মিথ্যা আশ্বাস। নিজের টাকা উঠাতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন গ্রাহকরা। জানান হতাশার কথা। তবে এ বিষয়ে ব্যাংকের শাখাগুলোর ম্যানেজাররা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন হেড অফিসে যোগাযোগ করতে। 

আরেক গ্রাহক বলেন, ক্যাশ দিতে পারছে না। চেক ক্লিয়ারিংয়ের টাকাও পাচ্ছি না। নগদ টাকা রেখে আজ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। টাকা পাচ্ছি না। আমার আড়াই লাখ টাকা আছে। দ্রুত আমাদের টাকা ফেরত দেয়ার দাবি জানান তিনি। একই রকম চিত্র দেখা গেছে মতিঝিল ও কাওরান বাজারের শাখাতেও। কাওরান বাজারের শাখায় সকাল ১০টায় একজন মহিলা আমানতকারী এসেছেন টাকা তুলতে। কিন্তু টাকা না পেয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে বাসায় চলে যান।

এদিকে ব্যাংকের দুর্দশা তুলে ধরে মাহবুব নামে একজন গ্রাহক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট করেন। তিনি বলেন, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক মৌলভীবাজার শাখায় গিয়েছিলাম টাকা উঠাতে। ব্যাংক থেকে বললো ক্যাশ সংকট। টাকা দিতে পারবে না। জানতে চাইলাম কতো দিন ধরে এই অবস্থা? উপস্থিত গ্রাহকরা জানালেন, দুই মাস ধরে এই ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না।

ব্যাংকের বক্তব্য: ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ বলেন, এটা সাময়িক সমস্যা। শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছি। 
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাস শেষে ব্যাংকটি কর্মীদের পুরো বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৩৩টি শাখায় ৩৫০ জন কর্মী আছেন।

বিশ্লেষকের বক্তব্য: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দুরবস্থার মধ্যদিয়ে যাওয়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন। শুধু পর্যবেক্ষক বসালেই হবে না, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা থাকতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে না পারায় ব্যাংকটি উন্নতি করতে পারছে না। ঋণ আদায়ে টার্গেট বেঁধে দেয়া। আদায় না হলে সে বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা। গতানুগতিক নির্দেশনা দিলে তাদের কোনো উন্নতি হবে না বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।

শেয়ারবাজারের চিত্র: এদিকে ধারাবাহিক লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়ে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। কোম্পানিটি ১৯৯০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। সূত্র মতে, সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৮৫ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে শেয়ার প্রতি ৩৮ পয়সা লোকসান হয়েছিল। গত ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট দায় ছিল ১৯ টাকা ৩৬ পয়সা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির শেয়ার অভিহিত মূল্যের (ফেসভ্যালু) নিচে লেনদেন হচ্ছে। ১৬ই মে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ৭০ পয়সায়। গত এক বছরের মধ্যে ব্যাংকটির শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৫ টাকা ৪০ পয়সায়। 

মূলধন ঘাটতি ও লোকসান: ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা ৬৬ কোটি ৪৭ লাখ ২ হাজার ৩০০টি। এরমধ্যে উদ্যোক্তাদের কাছে আছে ৫২.৭৬ শতাংশ, সরকারের কাছে ০.১৭ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২১.৬১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ২৫.৪৬ শতাংশ শেয়ার। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটির ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ৭৯০ কোটি ৪ লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের (বিনিয়োগ) ৮৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর্থিক সংকট নিরসনে গত ৩১শে জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতহীন ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তার আবেদন করেছিল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। তবে দুই সপ্তাহ পর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দায় ছিল।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। ফ্রোজেন ডিপোজিট হলো ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানত, যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে রেখেছিল। ব্যাংকটির ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ২ হাজার কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

Please follow and like us:
0
fb-share-icon20
Tweet 20
Pin Share20

Enjoy this blog? Please spread the word :)

Facebook20
YouTube20
Instagram20
20