সালেক সুফী।।
১৯৮৩ কুমিল্লায় আঞ্চলিক বিতরণ কার্যালয়ে খন্দকার মোমিনুল হকের তত্ত্বাবধানে যোগদান করে আমি ,শহিদুল আবেদীন এবং জয়নাল আবেদীন কুমিল্লা , চাঁদপুর এবং ফেনী সহ দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশে গ্যাস বিতরণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করি।বাগিচাগাঁও এলাকায় আমাদের কার্যালয় ছিল। সবাই জানে কুমিল্লা ইংরেজ শাসনের সময় থেকেই শিল্প সাহিত্যের পাদপীঠ ছিল।ফৌজিয়ান আমিনুর রহমান কুমিল্লার জেলা প্রশাসক থাকা অবস্থায় কুমিল্লার গণমান্য নাগরিকদের উৎবুদ্ধ করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কিছু স্মৃতি বিজড়িত স্থানে স্মারক স্থাপন করেন। চর্থা মুরগির ফার্ম ছিল এমন একটি স্থান। ভাবতে পারেন যে বাসায় বসে কবি এবং সচিন দেব বর্মন সংগীত চর্চা করতেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তাকে হাঁস মুরগীর খামার বানিয়ে রেখেছিলেন। শ্রদ্ধেয় আমিনুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। উনি কম বয়সেই মৃত্যু বরণ করেন। আমি সিলেটের গোলাপগঞ্জে তাঁর কবর জেয়ারত করেছি।
কুমিল্লায় এসে আমি চর্থা মুরগির ফার্মের সামনে বিজিএসএল অতিথি ভবনের পাশে বাসা ভাড়া করি। কোম্পানির কাজের পাশে আমি কুমিল্লার সামাজিক এবং ক্রীড়া মহলে সংযুক্ত হয়ে পরি। তিন নদী পরিষদ একটি সাহিত্য সঙ্গ ছিল।ওরা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস যেমন নববর্ষ, বিজয় দিবস , ভাষা দিবস , স্বাধীনতা দিবস , নববর্ষ পালন করতো। আমার বন্ধু বাবুল এই সব কর্মকান্ড পালন করতো। বিশেষত ফেব্রুয়ারী মাসের পুরোটাই প্রখ্যাত জাম তলায় প্রতিদিন অনুষ্ঠান হতো। আমি নিয়মিত যোগদান করেছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাহার ভাই ,আফজাল ভাইয়ের সঙ্গেও ভারসাম্য মূলক সম্পর্ক ছিল। কুমিল্লা ক্রিকেট লিগেও কিছু ম্যাচ খেলেছি। ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের সংযুক্তির কারণেই কুমিল্লার ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কুমিল্লাকে বলা হতো সিটি অফ ব্যাংকস এন্ড ট্যাংকস। আমি ,ফারুক ভাই এবং জমিদার বাড়ির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হায়দার ভাই সুযোগ পেলেই পুকুর দীঘিতে মাছ শিকার করতাম। প্রখ্যাত সমাজসেবক ডাক্তার জোবেদা হান্নানের সামাজিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিলাম।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরুর পর থেকেই বিজিএসএলের উপর প্রচন্ড চাপ ছিল কুমিল্লা ,চাঁদপুর এবং ফেনীতে স্বল্প সময়ে গ্যাস সরবরাহ করার। আবেদীনকে কুমিল্লার আমাকে চাঁদপুর এবং ফেনী এলাকায় গ্যাস সরবরাহের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। মহসিন ভাইয়ের উপর চাপ ছিল পেট্রোবাংলা থেকে প্রকল্প ব্যাবস্থাপক নিয়োগের। উনি আমাদের উপর আস্থাশীল ছিলেন। দুটো প্রকল্পের কাজে টিকাদার ছিল দীপন গ্যাস। সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ ভাইয়ের গ্যাসমিন। মাহমুদ রাশিদ ভাই জড়িত ছিলেন। সেই সময় দুটি প্রকল্প যথা সময়ে সম্পন্ন করা ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। আবেদীন এবং আমি কাজ চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিলাম। আমার সাথে শুরুতে মুস্তাফিজ এবং আবেদিনের সঙ্গে ছিল ফিরোজ আলম। কোনো এক বিশেষ কারণে ওদের দুইজনকে ক্লোজ করা হয়।ওরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলো ওই সময় পর্যন্ত গ্যাস সেক্টরের কাজে দুর্নীতির সুযোগ ছিল না।আমাদের তখন তারুণ্য। মনে সৃষ্টি সুখের উল্লাস , দেশ প্রেম। আমি আর আবেদীন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে বন্ধু সুলভ প্রতিযোগিতায় মেতেছিলাম। পাইপলাইন দুটো মূলত রোডস এন্ড হাইওয়েজের বরো পিটের শেষ প্রান্তে স্থাপিত। তুলনামূলক ভাবে চাঁদপুর ল্যাটারাল বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।তার পরেও আমাদের নিবিড় তদারকির কারণে প্রকল্প দুইটি সমান্তরালে এগিয়ে চলে। আমাদের সাথে দুটি প্রকল্পেই রেডিওগ্রাফি কাজে ছিল তিতাস গ্যাস বন্ধুর কোম্পানি এইআইএসবি। আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাছ ধরতাম ,পাখি শিকার করতাম। ফারুক ভাই আমার সঙ্গী থাকতেন। কতদিন ১০-১২ কেজি রুই ,কাতল , মৃগেল ধরেছি। প্রচুর পাখি শিকার করেছি। ওই সময় কুমিল্লার চারপাশে প্রচুর সবজি পাওয়া যেত।আমাকে একই সঙ্গে ফেনীর গ্যাস বিতরণ কাজ দেখতে হতো।কুমিল্লার বাহার ভাই। সবাই জানেন ফেনীর অঘোষিত সম্রাট ছিল জয়নাল হাজারী। আমার সাথে হাজারীর একটা সম্পর্ক বাখরাবাদ – চট্টগ্রাম পাইপলাইন পাইপ লাইন নির্মাণ সময় থেকে ভাল সম্পর্ক ছিল। ফেনীর কাজে জয়নাল হাজারী গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সহায়তা করেছিলেন।
কুমিল্লা এবং চাঁদপুরের কাজ যথাসময়ে শেষ হয়। কুমিল্লায় গ্যাস সরবরাহ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। কুমিল্লার পর ফেনীর গ্যাস সরবরাহ উঠবোধন করা হয়।তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান ফেনীতে গ্যাস সরবরাহ উদ্বোধন করেন। আমার সুযোগ হয়েছিল কুমিল্লা এবং ফেনীর প্রথম কিছু গ্যাস সংযোগ নিজে স্নাযুক্ত থেকে প্রদান করার। ফেনীর ডাক্তার পাড়ার রেখাদের বাড়িতে গ্যাসের চুলার রান্না করা খিচুড়ি খাওয়ার কথা মনে আছে। চাঁদপুরেও প্রথম ১০০ গ্যাস সংযোগের অন্তত ৩০ টি আমি নিজে গ্যাস জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। চাঁদপুরে প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান গ্যাস সরবরাহ উদ্বোধন করেছিলেন। চাঁদপুরে কাজের সময় মাঝে পদ্দার ইলিশ মাছ কিনতাম, মতলবের ছানার কাঁচা গোল্লা উপাদেয় ছিল।চাঁদপুরে গ্যাস সংযোগ উদ্বোধনের পরদিন আমাকে ঢাকায় বদলি করে ডেমরায় সঞ্চালন পশ্চিম শাখা খোলার দায়িত্ব দেয়া হয়।
কুমিল্লায় থেকে চাঁদপুর ,ফেনীতে গ্যাস পাইপ লাইনের কাজ করার সময় অগোচরে কোনো তরুণীর মনে তরঙ্গ তুলে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার ভালোবাসার স্ত্রী রোজী আমার পাশে থেকে আমাকে নীরবে সমর্থন দিয়ে গাছে।
চলবে।