সালেক সুফী।।
পশ্চিম ইউরোপ সফর আমাদের সবার জীবনে ছিল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। কিছুটা পেশাদারি প্রশিক্ষণ বাকি সবকিছুই ছিল দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন। আমরা ডেভেনটারে প্রশিক্ষণের একপর্যায়ে এন্ড হ্যাভেন পরিদর্শন করি। এটি ১৯৮০ দশকে ছিল হল্যান্ডের স্মার্ট সিটি। হল্যান্ডের প্রখ্যাত ফুটবল দল পিএসভি এন্ড হ্যাভেন এই শহরের। ১৯৮৮ প্রখ্যাত ডাচ ফুটবলের উহান ক্রয়েফ তখন দলের প্রশিক্ষক। ফুটবল প্রিয় ডাচ দের কাছে দেবতূল্য। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে হল্যান্ড ফুটবল দলের টোটাল ফুটবলের আমরাও ছিলাম অনুৰাগী। ওই সময় ক্যালগারিতে শীতকালীন অলিম্পিক হচ্ছিলো। ডাচ সুন্দরী ভোঁ গেনিপ কয়েকটি স্বর্ণপদক জিতে ডাচদের হৃদয়ের রানী তখন।এন্ড হ্যাভেনে ক্যাফে রেস্তোরায় ক্রোয়েফ এবং গেনিফ বন্দনা দেখেছি। আমরা ওই শহরে স্মার্ট টেকনোলজির ( স্মার্ট গ্রিড, স্ক্যাডা , স্মার্ট মিটার ) প্রাথমিক পার্ট নিয়েছিলাম।
আমাদের ইউরোপ যাত্রা শুরু হয় এর পর। একটি বিলাশবহুল বাসে চড়ে তিন সপ্তাহের ইউরোপ ভ্রমণে আমাদের সাথী ছিল আমাদের ট্রেনিং সমন্বয়কারী অনা ডিজং। আধুনিক বস্তিতে চা প্রস্তুতির ব্যবস্থা , টয়লেট সবই ছিল।আমরা বিশেষ করে গুলজার ভাইয়ের বিষয়ে অনেক সচেতন ছিলাম। প্রত্যেকে কিছু অতিরিক্ত ওষুধ সাথে নিয়েছিলাম। যাত্রা শুরু হলো আন্তর্জাতিক হাইওয়ে ধরে বেলজিয়াম যাত্রা পথে।আমরা ব্রাসেলস যাওয়ার পথে সিলভোল্ড শহরে যাত্রাবিরতি করলাম। সেখানে মিটারিং এবং রেগুলেশন বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।সানোয়ার এবং হাসান সেখানে আগেও এসেছে। পশ্চিম ইউরোপ অন্নান্য দেশ থেকে বেলজিয়াম কিছুটা অসচ্ছল। ফ্রান্স , জার্মানী ,ইংল্যান্ড ওদের নিয়ে অনেক ট্রল করে।কিন্তু আমাদের কাছে ব্রাসেলস শহরকে অত্যাধুনিক মনে হয়েছে। আমরা ন্যাটো সদর দপ্তর , এটোমিয়াম পরিদর্শন করেছি। বেলজিয়াম রাজপ্রাসাদ আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল। আমরা শহর কেন্দ্রে মনিকা পি নাম একটি মনুমেন্ট দেখলাম। একটি শিশুর মূর্তি প্রস্রাব করছে। পাশে আরেকটি মহিলার মূর্তি শুয়ে আছে। জনশ্রুতি মূর্তিটি ছুঁয়ে দিলে আবার পরিদর্শনের সুযোগ থাকে। আমরা সবাই ছুঁয়েছি। মনে হয়না ৩৫ বছরে আবারো কেউ সেখানে গাছে। বেলজিয়ামের জ্বালানি নিরাপত্তা মূলত হল্যান্ড থেকে গ্যাস আমদানি নির্ভর এবং কয়েকটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কারখানা আছে।বেলজিয়ামকে আমার ভালোই লেগেছিলো। আমরা সবাই একটি করে ডায়মন্ডের আংটি কিনেছিলাম।
তিন দিন বেলজিয়াম থাকার পর আমাদের সুযোগ হলো সড়ক পথে দক্ষিণ ফ্রান্স হয়ে উত্তর ফ্রান্স সড়ক পথে যাবার। বিশাল দেশ। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ। পথিমধ্যে আমরা রেইমস শহরে যাত্রা বিরতি করলাম। শহরটি শ্যাম্পেনের জন্য খ্যাত। আমরা একটি গ্যাস মিটার প্রস্তুতকারী কারখানা পরিদর্শন করি।দেখলাম রোবট দিয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে আধুনিক গ্যাস মিটার। বাংলাদেশে এই প্রিপেইড মেটেরগুলো সংযোজন করা হলে গ্যাস অপচয় রোধ করা যেত। সেখানে রেস্টুরেন্টে ফরাসি সুন্দরী তরুণীরা আমাদের ফ্রেঞ্চ শ্যাম্পেন খাওয়াতে প্রলুব্ধ করেছিল। আমাদের কয়েকজন ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে বিরত ছিলাম।
আমরা সন্ধ্যা নাগাদ দীর্ঘ পথযাত্রা শেষে স্বপ্নের প্যারিসের কেন্দ্র স্থলে হোটেলে পৌঁছলাম। প্যারিসে অবস্থানকালে আমরা বিশ্বখ্যাত লুভ মিউজিয়াম , আইফেল টাওয়ার , ভার্সাই প্যালেস পরিদর্শন করি।সুগন্ধির জন্য বিশ্বখ্যাত প্যারিসে আমরা পারফিউম মিউজিয়াম পরিদর্শন করি। মনে আছে আমরা সবাই অন্তত একটি করে ব্রান্ডের পারফিউম কিনেছিলাম। আইফেল টাওয়ার পরিদর্শন আমাদের জন্য খুব আকর্ষণীয় ছিল। লাভ মিউজিয়ামে জগৎখ্যাত মোনালিসার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। ভার্সাই প্যালেস সফর আমাদের ফরাসি সংকৃতির সঙ্গে পরিচিত করেছিল। প্যারিস শহরতলীর সন্ধ্যা ছিল মোহনীয়। রাতের প্যারিস নাচে গানে জেগে থাকতে দেখেছি। আমাদের হোটেলে ইটালী থেকে আশা স্কুলের ছেলে মেয়েরা ছিল।সারা রাত্রিওরা কিচির মিচির করতো। তিনদিনের ফ্রান্স সফরের স্মৃতি এখনো আমাদের আপ্লুত করে।
ফ্রান্স থেকে আমরা যাই সুইজারল্যান্ডের পার্বত্য শহর দেলেমন্ট। সুইজারল্যান্ড দুনিয়ার অন্যতম ধোনি দেশ।দুনিয়ার বিলিওনিয়াররা সেখানে সাদা কালো টাকা নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করে। পাহাড়ি শহরটিতে রাত কাটিয়ে আমরা প্রাকৃতিক স্বর্গ লুজার্ন শহরে যাই। পাহাড় আর ঝর্ণাধারা ঘেরা লুজার্ন শহর পর্যটকদের স্বর্গ। বন্ধুরা অনেকেই না গেলেও আমি এবং জালালাবাদ গ্যাসের দুইজন ৭০ গিল্ডের খরচ করে কেবেল কারে চড়ে দুনিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট টিটলিস পরিদর্শন করি।সেখানে শৃঙ্গে প্রকৃতিক ভাবে তৈরী গ্লেসিয়ার টানেল দেখার সৌভাগ্য হয়।পাহাড় চূড়ায় রেস্টুরেন্টে একজন প্রবাসী বাংলাদেশির দেখা মেলে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের একসময়ের চৌকষ জাসদ ছাত্রলীগ নেতা বিভ্রান্ত হয়ে পচিম ইউরোপ এসে রিফুজি হয়ে কখনো জার্মানি , কখনো হল্যান্ড ,কখনো বেলজিয়াম ঘুরে এখন একজন সুইস মেয়ে বিয়ে করে লুজার্নে স্থায়ী হয়েছে।
ইউরোপ সফরের শেষ ছিল আমাদের জার্মানি ভ্রমণ। জার্মানি তখন পুনরায় একত্রীভূত হয় নি।আমাদের জার্মান সীমান্তে প্রায় একঘন্টা থেকে নানাভাবে প্রমান দিতে হয়েছিল আমরা কোনো দেশের সন্ত্রাসী নই। আমরা দুইদিন হল্যান্ডের সীমান্ত সংলগ্ন জার্মানির ডুসেলডর্ফ একটি প্রান্তিক শহরে ছিলাম। সেখানে মানেসমান পাইপ তৈরির কারখানায় আমাদের গ্যাস পাইপ তৈরির আধুনিক কারিগরি কৌশল দেখানো হয়।পচিম ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত এবং স্বচ্ছল দেশ তখন পশ্চিম জার্মানি। অন্নান্য দেশগুলোর তুলনায় জীবন যাত্রায় কিছুটা বেপরোয়া ভাব।দ্রুতগতিতে শুধু গাড়ি চালনাই নয় ওদের জীবনযাত্রায় অনেকটা বেপরোয়া ভাব।এই জার্মানীর হয়ে একসময়ে এডলফ হিটলার বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখছিলো। জার্মানদের আন্তরিকতায় মুদ্ধ হয়েছিলাম। সন্ধ্যায় আমরা তুর্কিশ রেস্টুরেন্টে বসে ইউরোপিয়ান ফুটবল লীগের খেলা উপভোগ করেছি। আমাদের গুলজার ভাই একটি কয়েকটি শার্ট কিনে এনে জানালেন অনেক সস্তায় কিনেছেন। আমরা পরে দেখলাম এগুলো সব বাংলাদেশ থেকে এসেছে যা উনি কেনার সময় দেখেন নি।
দেখতে দেখতে শেষ হলো আমাদের পশ্চিম ইউরোপ সফর।জানিনা বাংলাদেশের কতজন প্রকৌশুলীর এই ধরণের বহুমাত্রিক পশ্চিম ইউরোপ সফরের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ডিভেন্টের ফিরে এসে আমাদের প্রশিক্ষণের শেষ পর্ব শুরু হলো।
চলবে।