সালেক সুফী।।
কয়েকটি বিশেষ কারণে সিলেট গ্যাস ফিল্ডে সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। আমাকে গ্যাস খুব খনন , উৎপাদন বিষয়ে অনেক কিছু হাতে কলমে শিখিয়েছিলেন বুয়েট অগ্রজ কেমি কৌঁসুলি কাজী শহীদ। তিনি পেট্রোবাংলার পরিচালক থাকা অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ওই সময় পেট্রোবাংলা এক্সপ্লোরেশন ডিভিশন সিলেট ৮ নাম একটি গ্যাস কূপ খনন কাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলো। ওই টাইম কয়েকজন রিগার , মাড় মিক্সার , সিমেন্টেশন বিশেষজ্ঞ ছিল। ওদের কাছ থেকেও শিখেছিলাম। সহকর্মী ফোরম্যান মহসিন থেকেও শিখেছিলাম। এছাড়া পেট্রোবাংলার পিআইইউ প্রকল্পে কর্মরত এমদাদ ভাই , রুহুল আমিন ভাইয়ের সঙ্গেও কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রখ্যাত বি করিম সাহেবের সাথেও কাজ করেছি। কোম্পানির উৎপাদন বিভাগে সংগ্যাস রক্ষিত পুরানো নথি পরে সুরমা বেসিন এলাকায় গ্যাস সম্ভাবনা বিষয়ে একটি বিস্তারিত ধারণা হয়েছিল। বিশেষত ১৯৬০ দশকের শুরুতে পানিছড়া এলাকায় প্রথম গ্যাস কূপ আবিষ্কার ,প্রথম কূপে ব্লো আউট বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য , সিলেট ২-৬ খনন , হরিপুর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণের বিস্তারিত তথ্য পড়ে ছিলাম। একই সঙ্গে ছাতক গ্যাস কূপ আবিষ্কার এবং ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত হয়েছিলাম। তথ্যগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে আমার একটি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। অনেকেই জানেন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে ৭ টি গ্যাস কূপ ছিল. ১-৬ স্বাধীনতার পূর্বে খনন হয়েছিল। সিলেট ১ বাংলাদেশ অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রথম গ্যাস কূপ। যেখানে প্রথম ব্লো আউট হয়ে রিগ ভূগর্বে তলিয়ে যায়। এখনো সেখান থেকে বুদ্বুদ আকারে গ্যাস বের হচ্ছে। সিলেট ২ রিলিফ অয়েল ছিল। সিলেট ৩ উৎপাদন কূপ ছিল।সিলেট ৪ আবারো ব্লো আউট হয়। সেখানে এখনো পাহাড়ে গ্যাসের আগুন মৃদু মৃদু জ্বলছে। সিলেট ৫ রিলিফ অয়েল ছিল। সিলেট ৬ উৎপাদনে ছিল. সিলেট ৭ খননের সময় তেল আবিষ্কৃত হয়।
সিলেট শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সিলেট -তামাবিল সড়ক সংলগ্ন গ্যাস ফিল্ড এলাকা নয়নাভি রাম। তেল কূপ আবিষ্কারের পর প্রায় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ,বেসামরিক কর্মকর্তা , বিদেশী দূতাবাসের মানুষ পরিদর্শনে আসত। কয়েকবার ক্যাডেট কলেজের ছাত্র শিক্ষকরা সফরে।এসেছিলো। আমাকে প্রটোকল অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হতো। কতবার জাফলং তামাবিল যেতে হয়েছে। তামাবিল এলাকায় বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান ভাইয়ের একটি চা বাগান আছে. পূর্বপরিচিতির সূত্রে বেশ কয়েকবার গেছি সেখানে।
আমি মাঝে মাঝে পিআইইউ গ্যাস কূপ খনন কাজ দেখতে বিয়ানীবাজার ,কৈলাশটিলা গ্যাস ক্ষেত্র পরিদর্শনে যেতাম। বিয়ানীবাজার জলঢুপ এলাকায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ মহোদয় কর্তৃক বিয়ানীবাজার কূপ ২ উদ্বোধন সময়ে উপস্থিত ছিলাম। কৈলাশটিলা ২ লোকেশনে ড্রিলিং কালে তেলের স্তর পাওয়া গিয়েছিলো। সেদিন আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। পরে কূপটি গ্যাস স্টোরে শেষ হয়।মনে আছে আমি কোপনাইর নিজস্ব জনবল দিয়ে কৈলাশটিলা গ্যাস ক্ষেত্রের সিলিকা জেল টাওয়ার রক্ষনাবেক্ষন করেছিলাম। এই সময় আমি বিসিআইসির মালিকানায় থাকা পাইপলাইন এবং খাদিম নগরে থাকা কার্যালয় কোম্পানিতে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। কৈলাশটিলা ২ থেকে কৈলাশটিলা ১ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ কাজের উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
আগেই বলেছি তেল কূপটি আবিষ্কারের পর অশুভ প্রভাবে সিমিটার নামের একটি অখ্যাত কোম্পানির কাছে সুরমা বেসিনের বিস্তীর্ণ এলাকা অস্বচ্ছ ভাবে লিজ দেয়া হয়. এই ঘটনাটি পেট্রোবাংলা বা সাধারণ জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সিলেট এলাকায় তীব্র সিমিটার বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে. মহাব্যবস্থাপক মীর নাজির হোসেনকে বদলি করা হয়।আমাদের অনেক সতর্কতার সঙ্গে কাজ করার উপদেশ দেয়া হয়।অনেকে ধারণা করেন সিমিটার বিষয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট , জ্বালানি মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন এবং বেক্সিমকোর সম্পৃক্ততা ছিল।
যাহোক একদিন সিমিটারের একটি দল পেট্রোবাংলার পরিচালক পরিকল্পনা কর্নেল (অব) ওয়ালী সাহেব সহ পরিদর্শনে আসে। সিমিটারের পক্ষ থেকে একজন লেবানিজ, একজন পাকিস্তানী এবং কয়েকজন কানাডিয়ান ছিল।আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় ওদের সিলেট ৭ তেল কূপ এবং অন্নান্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখতে। আমি বিনীত ভাবে জানাই আমার পক্ষে সিলেট ৭ দেখানো সম্ভব না।সরকারের নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনা ছাড়া বহিরাগত কেউ সিলেট ৭ অনুপ্রবেশ করতে পারবে না।আমি পরিদর্শন দলকে অন্নান্য এলাকা ঘুরিয়ে দেখাই। এই দলে আমার সহপাঠী বন্ধু মেজর ( অব) তালিবুল মওলা ছিল।আমি জানি আমার জবাব পেট্রোবাংলা পরিচালকের পছন্দ হয় নি।আমি সবার সঙ্গে অতিথি ভবনে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণ করতে বিনীত ভাবে অস্বীকৃতি জানাই।
অফিস ফিরে বসে আছি এমন সময় বন্ধু মওলার সঙ্গে একজন কানাডিয়ান , একজন পাকিস্তানী এসে আমার কাছে সিলেট ৭ উৎপাদন রেকর্ড সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে চায়।বন্ধু মওলা জানায় বিনিময়ে আমাকে মূল্যবান উপহার দেয়া হবে। আমি কোনোভাবে রাজি হয় নি দেশের সঙ্গে বিস্বাসঘাতকতা করতে। ব্যার্থ হয়ে ওরা ফিরে যায়। পরিণামে পরদিন সকালে এসে আমি জালালাবাদ গ্যাস কোম্পনীতে বদলি আদেশ এবং তাৎক্ষণিক অবমুক্তির নির্দেশ পাই। স্বপ্ন ছিল নিজেদের উদ্যোগে আরো কিছু তেল কূপ অনুসন্ধান। আবারো স্বপ্ন সাথী করে সরকারি আদেশ মেনে হতাশা নিয়ে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে যোগদান করলাম। বলাবাহুল্য একসময় তীব্র আন্দোলনের মুখে একসময় সিমিটারকে বাংলাদেশ থেকে ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে হয়।
চলবে।