সালেক সুফী।।
পশ্চিম ইউরোপ থেকে ফেরার পর সবার মাঝেই একটি চাঙ্গা ভাব দেশে। ফেয়ার উত্তেজনাও কারো কারো মাঝে। আমাদের কয়েকজনের সাথে অতিথিপরায়ণ ডাচদের অনেক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মারিয়া আমাকে এবং আবেদীনকে নিজের ছেলের মতো আদর করতো। শুনছি ওর একমাত্র ছেলে শিশু বয়সে মারা গিয়েছিলো। ভদ্র মহিলা ইংরেজি খুব একটা জানতো না. আমরাও শুধুমাত্র কয়েকটি ডাচ শব্দ শিখেছিলাম। মারিয়া ওদের বাংলো পার্ক রেস্টুরেন্টে গানের অনুষ্ঠান করতো মাঝে মাঝে আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য। ফ্লেম কনসার্ট দল নিয়ে এসেছিলো। আমরা একবার ওদের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম এবং এমনকি স্টেজ উঠে লিপিং করেছিলাম ডাচ গানের সঙ্গে। মারিয়া আমাদের একটি পুরানো বৈমানিকদের ক্লাবে নিয়ে যেত. আমরা প্যারাসুট জাম্পিং অনুশীলন নিতে শুরু করেছিলাম।
প্রশিক্ষণের একটা পর্যায়ে আমাদের সীমান্তের কিছু এক্সপোর্ট স্টেশন পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সবগুলো স্টেশন গ্রনিগেনে কেন্দ্রীয় স্কাডা কন্ট্রোল সেন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও লোকাল কন্ট্রোল ছিল।প্রতিটি স্টেশনে অনলাইন ক্রোমাটোগ্রাফ এবং ডিউ পয়েন্ট টেস্টার ছিল. মিটার ক্যালিব্রেশন করা হতো মাসিক ভিত্তিতে। তখন জার্মানি এবং বেলজিয়াম থেকে প্রকৌশুলীরা আসতো। আমরা একবার জার্মানির সঙ্গে যৌথ ক্যালিব্রেশনের সময় উপস্থিত ছিলাম। জার্মান প্রকৌশীলীদের হ্যাপি গো মেরী মনে হয়েছিল। আলসেশিয়ান কুকুর নিয়ে হেটে হেটে সীমান্ত অতিক্রম করে এসেছিলো। আমাদের সাথে আলোচনায় অনেক স্বপ্রতিভ ছিল।আমাদের সাথে থাকা গাসুনি প্রকৌশুলি আমাদের হাওলান্ড সীমান্তে থাকা কয়েকটি গ্যাস এবং তেল ক্ষেত্র দেখিয়ে জানালো এগুলো জয়েন্ট ডেভেলপমেন্ট এগ্রিমেন্টের (JDA ) আওতায় হল্যান্ড পরিচালনা করে। বাংলাদেশ ভারত এবং বাংলাদেশ -মায়ানমার সীমান্তে থাকা কিছু গ্যাস ক্ষেত্র ( জলে অথবা স্থলে) আবিষ্কৃত হলে সেগুলো এভাবে পরিচালিত হতে পারে।
হল্যান্ডে থাকা অযথায় দুই ধরণের খবর পেয়েছিলাম। কেউ কেউ জানিয়েছিল আমার সিলেট গ্যাস ফিল্ড বদলি আদেশ বাতিল হয়েছে। আবার এটাও শুনেছিলাম আমরা ফিরলে আমাকে সিলেট গ্যাস ফিল্ডে যোগদান করতে হবে। বাংলাদেশ ওই সময় হরিপুরে ৭ গ্যাস কূপ খননের সময় তেল আবিষ্কার করে। বাংলাদেশের প্রথম তেল কূপ পরিচালনার চ্যালেঞ্জ নিতেও ব্যাকুল ছিলাম। এছাড়া আমার দ্বিতীয় সন্তান অভ্রকে দেখার জন্য মন ব্যাকুল ছিল।
গাসুনী ২৫ বছর অপারেশন শেষ করায় ওদের বড় ধরণের উৎসব আয়োজন আমরা কয়েকদিনের জন্য মিস করেছিলাম। তবে ওদের উৎসব উপলক্ষ করে আবেদীন, আমার এবং কাসেমের একটি ইন্টারভিউ ওদের স্মরণিকায় ছাপা হয়েছিল। এখন স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমাকে অন্তত দুটি কোম্পানি পশ্চিম ইউরোপ চাকুরীর আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। একদিকে দেশের প্রথম তেলক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ অন্যদিকে দ্বিতীয় সন্তান। আমি বিনীতভাবে চাকুরীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তবে একজন ডাচ বিশেষজ্ঞর কাছ থেকে Waxy crude well পরিচালনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম।
শেষ সপ্তাহে জানানো হলো আমাদের পরীক্ষা হবে এবং পরীক্ষার ভিত্তিতে সনদ দেয়া হবে।যথাসময়ে পরীক্ষা হলো এবং আমাদের formally অনুষ্ঠানের মাদ্ধমে সনদ পত্র দেয়া হয়েছিল। আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠান হয়েছিল কাকলহফ মারিয়ার রেস্টুরেন্টে। অনেক ডাচ বন্ধু আমাদের বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিল।
যাবার আগের দিই শুরু হলো আমাদের গোছ গাছ। তিন মাসে সবাই অনেক কিছু ক্রয় করেছিল ওজনের বাখ বিচার না করেই। আমাদের অনেকেই অনেক কিছু ফেলে আসতে হয়েছিল। বিদায় মুহূর্তে সবাই প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার বেদনা অনুভব করেছিলাম। বিশেষত আমাদের কোঅর্ডিনেটর ওনা ডিজং এবং মারিয়া পরিবারের আন্তরিকতা ছিল আপন জনের মতোই।
হল্যান্ড তথা পশ্চিম ইউরোপের এই কার্যকরী প্রশিক্ষণ আমাদের অনেককেই পরবর্তী কর্মজীবনে বাংলাদেশের গ্যাস সেক্টরে অবদান রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলো। আবেদীন, সানোয়ারের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে।গুলজার ভাই ইন্তিকাল করেছেন। জালালাবাদ গ্যাসের তিন বন্ধু প্রবাসে শুনেছি। জামিল অবসরের পর ঢাকায় আছে। হাসান চট্টগ্রামে। রফিক সম্ভবত ময়মনসিংহ আছে। সবার জন্য শুভ কামনা।
অনেক স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম নিরাপদে বাংলাদেশে।
চলবে।