সালেক সুফী।।
বিজিএসেলে দ্বিতীয় অধ্যায়
বিজিএসএল থেকে ১৯৮৮ -১৯৯০ প্রেষণে সিলেটের দুটি কোম্পানিতে এক বছর করে কাজ করার পর পেট্রোবাংলার প্রয়োজনে ১৯৯০ ফেব্রুয়ারী আমাকে আবারো বিজিএসেলে ফেরত আনা হয়। ইতিমধ্যে বিজিএসএল অনেক বদলে গেছে। আঞ্চলিকতার বিষবাষ্পে সৎ নিরীহ কর্মকর্তারা কোনঠাসা। গ্যাস বিপণনে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম। কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভক্তি সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। বিশেষত কুমিল্লা চট্টগ্রাম দ্বন্দে কোম্পানি তার প্রাথমিক আদর্শ থেকে দূরে সরে গাছে। বাখরাবাদ এবং ফেনী গ্যাস ক্ষেত্রের অপারেশন কাজ বিজিএফসিএলে হস্তান্তরিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর দুইজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব ) সাদেক এবং মেজর ( অব) রায়হানুল আবেদীন মহাব্যবস্থাপক হিসাবে যোগদান করেছেন। শুরু থেকে থাকা খন্দকার মোমিনুল হক এবং মুঈনুল হাসান আছেন মহাব্যবস্থাপক হিসেবে। তিতাস গ্যাস থেকে অভিজ্ঞ গ্যাস প্রকৌশুলি শামসুদ্দিন আহমেদকে ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমার প্রত্যাবর্তন অধিকাংশ কর্মকর্তা কর্মচারী স্বাগত জানালেও কিছু কিছু কর্মকর্তার অসহিষ্ণুতার কারণ হয়েছিল বুঝতে পারি।
এই সময় বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে গ্যাস ট্রিটমেন্ট প্লান্টসমূহ ঠিক মতো কাজ না করায় বিপুল পরিমান কনডেনসেট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন অনুপ্রবেশ করে. আমি যোগদান করার আগেই সদ্য যোগদানকৃত ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের যোগ্য নেতৃত্বে বাখরাবাদ -ডেমরা পাইপ লাইনের ওন স্ট্রিম পিগ্গিং ( Onstream Pigging ) কাজ সফলভাবে সম্পাদন করা হয়। আমি ফিরে আসার পর শুরুতে আমাকে ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম ২৪ বাসের ১৭৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন এবং চট্টগ্রাম শহর বেষ্টিত রিং মেইন onstream pigging কাজ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়।শুরুতে আমি তিন মাস কোম্পানির বোর্ড রুমে বসে অফিস করেছি। আমার সঙ্গে শুধুমাত্র একজন টাইপিস্ট কাজ করেছে। ইতিমধ্যে চাঁপাপুরে কোম্পানি সদর দপ্তরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবাসন তৈরী হয়ে যাওয়ায় আমি আমার পরিবারকে ঢাকা থেকে কুমিল্লা স্থানান্তর করি. ১৯৯০-১৯৯৪ কুমিল্লা অফিস ক্যাম্পাসে চাকুরী জীবনের স্মরণীয় সময় কেটেছে। খেলাধুলো , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , কোম্পানির বার্ষিক বনভোজন , ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম এই সময়ে। ক্যাম্পাসের তরুণ ছেলে মেয়েদের একটি শক্তিশালী ক্রিকেট দল গঠন করেছিলাম।
বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম অনস্ট্রাম পিগ্গিং একটি বিশেষ অধ্যায় বিধায় আলাদা ভাবে লিখবো। তবে বলে রাখি ১৯৯০-৯১ কোম্পানির নিজস্ব জনবল ব্যবহার করে এত বড় কাজ নিরাপদে প্রথম বার করা এখনকার মত এতো সহজ ছিল না।
ওই সময়ে বার্ষিক মূল্যায়নে আমাদের চারজন শহিদুল আবেদীন, আমি, গুলজার হেসন আলমগীর এবং সাইফুল আহমেদ চৌধুরীকে উপমহাবাবস্থাপক হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হয়. আমাকে মুঈনুল আহসানের অধীনে পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার সাথে তিনজন ব্যাবস্থাপক ছিল. প্রকৌশুলি শাহাদাত আলী ছিলেন কর্পোরেট প্লানিংয়ের দায়িত্বে , প্রকৌশুলি নজরুল ইসলাম খান ছিলেন ফরওয়ার্ড প্ল্যানিং এবং প্রকৌশুলি সত্যনারায়ণ সাহা মেটেরিয়াল প্ল্যানিং দায়িত্বে। মুঈনুল আহসান সাহেবকে জানিয়েছিলাম আমরা কোম্পানি পরিচালনায় ইঞ্জিনিয়ারিং শৃঙ্খলা আনবো। বিতরণ নেটওয়ার্ক লাভ জনক না হলে সম্প্রসারণ করা হবে না. উল্লেখযোগ্য যে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক চাপে দাগনভূইয়া , বসুরহাট , সেনবাগ , মুরাদনগর , দেবীদ্বার এবং চট্টগ্রাম এলাকায় অনেক স্থানে বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হওয়ায় কোম্পানির আর্থিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়ছিলো। এছাড়া প্রয়োজন অপ্রয়োজন বাদ বিচার না করেই বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করে বিপুল পরিমান পাইপ লাইন নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় করা হয়েছিল। আমরা উদ্যোগ নিলাম বাড়তি উপকরণ পেট্রোবাংলার অন্নান্ন কোম্পানি সহ বিসিআইসি , পিডিবি , বিএডিসির কোম্পানি সমূহে আমাদের ক্রয় মূল্যে বিক্রয় করবো। মনে আছে দুই বছর সময়ে আমরা ৬০-৭০% বাড়তি উপকরণ বিক্রয় করে ইনভেন্টরি হ্রাস করেছিলাম। সত্য নারায়ণ সাহা ভুল বুঝতে পেরেছিলো। এছাড়া কোম্পানির নিজস্ব জনবল ব্যবহার করে প্রকৌশুলি সানোয়ার হাসান চৌধুরীর দায়িত্বে রাউজান পাওয়ার প্লান্ট এবং এমনকি কাফকো সার কারখানার প্রাথমিক সিএমএস ফ্যাব্রিকেশন করেছিলাম।
ওই সময়ে আমরা পরিকল্পনা বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম সিজিএস ক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং রিং মেইন থেকে রাউজান বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন সম্প্রসারণ কাজ হাতে নেই। প্রকল্প ব্যাবস্থাপক প্রকৌশুলি সানোয়ার হোসেন চোধুরীর দায়িত্বে পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ যথাসময়ে সমাপ্ত হয়। পাইপলাইন রিং মেইন সংযুক্তির সময় একটি সভাব্বো দুর্ঘটনা থেকে সামান্যের জন প্রাণে বেচেছিলাম। সেই প্রশ্নে পরে আসবো
সবচেয়ে ভালো কাজটি করেছিলেন প্রকৌশুলি শাহাদাত আলী। তিনি একটি সফ্টওয়ার ব্যবহার করে কোম্পানির সব শিল্প এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের মাসিক গ্যাস ব্যবহার মনিটরিং ছক তৈরী করেন। বিতরণ বিভাগ থেকে আমাদের প্রতিমাসে গ্যাস ব্যবহার হিসাব নিদৃষ্ট ছকে প্রেরণ করার পর আমরা সহজেই গড় মিল দেখে বুঝতে পারি কোন এলাকায় গ্যাস ব্যবহার হিসাবে গড় মিল আছে। বিষয়টি আমরা প্রাথমিক ভাবে মহাব্যবস্থাপক পরিকল্পনার মাদ্ধমে ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের নজরে আনি। ইতিমধ্যে জানাজানি হয়ে গাছে গ্যাস বিতরণ কাজে বিপুল পরিমান গ্যাস চুরি হচ্ছে এবং এর সঙ্গে কোম্পানির একটি দুষ্ট চক্র জড়িত হয়ে পড়েছে। মুঈনুল আহসান এবং সাদেক সাহেব এই বিষয়ে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেন। আমাকে প্রধান করে ,ওয়াহাব সাহেব এবং অর্থ বিভাগের একজন বাবস্থাপককে সদস্য করে ভিজিলেন্স কমিটি গঠন করা হয়।কোম্পানি এবং পেট্রোবাংলার একটি বিশেষ সুবিধাভোগী মহল শুরু থেকেই এই উদ্যোগে নাখোশ ছিল। আমরা আমাদের নিজস্ব হোমওয়ার্ক এবং বিশ্বস্থ সূত্রে খবর সংগ্রহ করে প্রথম পরিদর্শনে চট্টগ্রাম বিতরণ এলাকায় শুধুমাত্র নাসিরাবাদ ১৮ টি শিল্প কারখানায় অবৈষ গ্যাস ব্যবহারের কারণে গ্যাস সংযোগ সরাসরি বিচ্ছিন্ন করি।কালুরঘাট ,হালিশহর এমনকি চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় কিছু কিছু গ্রাহকের অবৈধ গ্যাস ব্যবহার চিন্নিত করি. আমাদের কাজ শুরুর সংবাদ শুনে একজন প্রকৌশুলি চাকুরী ছেড়ে নিউ জিলণ্ড প্রবাসী হয়। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম আমার সাথে কাজ করা একজন চৈকোষ প্রকৌশুলীকে এই কাজে জড়িত দেখে। অবশ্য সেই কিছুদিন পর চাকুরী ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী হয়।আমরা কাজ চালু থাকা অবস্থায় আমাকে বিশ্ব ব্যাংকের একটি বিশেষ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কাজ করার জন্য ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। জানি একটি অশুভ মহলের হাত ছিল এর পেছনে। কোম্পানি তথা পেট্রোবাংলা এমনকি তৎকালীন ,মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তদের সঙ্গে গ্যাস চোরদের যোগসাজোগ ছিল. কোম্পানিতে গ্যাস চুরি মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পরে।
আমি কুমিল্লায় ফেরার পর বাখরাবাদ কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ আমার কার্যালয়ে এসে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।আমি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতির হাতে একটি দাপ্তরিক ফাইল দেখেছিলাম যেখানে তার গ্রামাঞ্চলে গ্যাস বিতরণ পাইপ লাইন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা কোম্পানির জন্য লাভজনক না হওয়ার কারণে আমরা সম্মত হয় নি. কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে বিপুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। পরে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ক্ষমা প্রার্থনা করায় আমি ক্ষমা করেছিলাম। ওই সময় পেট্রোবাংলা থেকে আমাকে নবগঠিত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিতে বদলির সুপারিশ আসে।আমি আমাদের পরিকল্পিত কাজ অসমাপ্ত রেখে বিজিএসএল থেকে যেতে সম্মত ছিলাম না।যাহোক কিছু উর্ধতন কর্মকর্তা সহ কিছু প্রকৌশুলীর দুর্নীতি প্রবণতা দেখে একসময় বিজিএসএলের সঙ্গে সম্পর্ক চুতি করে ১৯৯৪ জুলাই মাসে জিটিসিএল যোগদান করি।
আমাদের পরিকল্পনায় বিজিএসএল পরিক্যাহিত হলে কোম্পানির বিভক্তির হয়তো প্রয়োজন হতো না। কর্ণফুলী গ্যাসকে একজন মহাদুর্নীতি বাজে দুর্নীতির অভয়ারণ্য বানাতে পারতো না। বিজিডিসিএলে এতো অবৈধ গ্যাস সংযোগ থাকতো না।দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতি লব্ধ অর্থ প্রদর্শন করে কানাডায় পারি জমিয়েছে। অভিযোগ আছে কেউ কেউ ভারতে টাকা পাচার করে সম্পত্তি ক্রয় করেছে। কিছু দিন আগে কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার [পর্যন্ত করা হয়েছিল। অথচ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিকল্পনা করা বিজিএসএল বিতরণ ব্যাবস্থায় প্রতি বিন্দু গ্যাস ব্যবহার নিবিড় ভাবে মনিটরিং সুযোগ ছিল।
চলবে।