সালেক সুফী।।
আমি কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান , প্রেসিডেন্ট লেফট্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ ,প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি খাতের অনেক শীর্ষ স্থানীয় অবকাঠামো নির্মাণ কাজে সরাসরি জড়িত ছিলাম। কাজের স্বার্থে সমসাময়িক মন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে পরিচয় যোগাযোগ হয়েছে। সরকার প্রধান সবাই আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনতেন। আমি সব সরকার প্রধানের মাঝেই গ্যাস সেক্টর এনার্জি সেক্টর নিয়ে কম বেশি কমিটমেন্ট দেখেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ কার্যকালে কয়েকটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস অবকাঠামো নির্মাণকাজে জড়িত থাকায কয়েকবার সরাসরি দেখা এবং কথা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পরকালে নেপালের কাঠমুন্ডুতে অনুষ্ঠিত বহুজাতিক সেমিনারে জ্বালানি নিয়ে একমাত্র নিবন্ধ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন আমি পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি হয়ে ইউনোকলের গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়ন কার্যক্রমের তদারকি করতাম। এই সময়ে আমি গ্যাস সেক্টরের সাতটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পাচঁটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। বিদ্যুৎ সেক্টরের দুই একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগের সহায়ক ছিলাম।
বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯০ -১৯৯৬ কার্যকালে আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ ৩০ ইঞ্চি বাসের উচ্চচাপ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের জটিলতার সময় একবার দেখা হয়েছিল। উনার ভাই সাঈদ এস্কান্দার আমাদের সমসাময়িক ছিল।২০২-২০০৬ কার্যকালে আমি পরিচালক (অপারেশন) হিসাবে জিটিসিএলে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলাম। তখন উনি আমাদের জ্বালানী মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকায় মাঝে মাঝে সংকট মুহূর্তে ওনার নিকট থেকে পরোক্ষ ভাবে নির্দেশ প্রয়োজন হতো। ওই সময়ে আমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে যুক্তরাষ্ট্র ,কানাডা , মালয়েশিয়া এবং মায়ানমার পাঠানো হয়েছিল। ইউএসএইড আয়োজিত সার্ক এনার্জি সেমিনার নিয়ে কয়েকবার নেপাল , ভারত ,কলম্বো সফর করেছি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এক্ট প্রণয়ন কাজেও আমি পরামর্শকদের সাথে কাজ করেছি এই সময়।অন্যতম প্রধান কাজ ছিল হবিগঞ্জ -আশুগঞ্জ ৩০ ইঞ্চি বাসের ৪০ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মাণ ব্যাবস্থাপনা। এই সময় সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র থেকে সলিমপুর ফৌজদার হাট পর্যন্ত সাগর বক্ষে নির্মিত পাইপ লিনের অংশবিশেষ পুন স্থাপন প্রয়োজন হওয়ায় ঈদের ছুটির সময় ১০ দিন তদারকি কাজে সাগর তরীতে নিয়োজিত ছিলাম। গ্যাস সিস্টেমে প্রায় সংকট হতো নানা কারণে বিশেষত সাগর বক্ষের সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদন বিভ্রাট অথবা বিয়ানীবাজার -কৈলাশটিলা কনডেনসেট ছিদ্র হয়ে আগুন ধরার কারণে। আমাকে ২৪/৭ সিস্টেম নিয়ে লড়াই করতে হতো।আমাকে ফেব্রুয়ারী ২০০৫ তিন জাতি মায়ানমার -বাংলাদেশ- ভারত পাইপলাইন প্রকল্প আলোচনায় বিশেষজ্ঞ করে পাঠানো হয়েছিল। জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী একটি খসড়া এমওইউ সম্পাদনে মুখ ভূমিকা পালন করেছিলাম।
যতদিন জনাব একেএম মোশাররাফ হোসেন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বৈরী পরিবেশেও কাজ করতে অসুবিধা হয় নি। কিন্তু বিতর্কিত কারণে উনি অপসারিত হবার পর আমার বুয়েট সহপাঠী ,তিতাস সহকর্মী ,বিশিষ্ট বন্ধু জনাব মাহমুদুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হওয়ার পর সম্পর্কে ফাটল ধরে। এক ধরণের জ্বালানি সিন্ডিকেট হাওয়া ভবনের সহায়তা নিয়ে আমার চাকুরীর চুক্তি বাতিল করে।আমাকে ২০০৫ অগাস্ট মাসে চাকুরীচুত করা হয়।সেই সময় অশুভ মহল নিয়মিত আমার স্ত্রী পরিবারকে নানা ধরণের হুমকি দিতো। কৌশলগত কারণে আমি আমার বন্ধুদের সহায়তায় জীবিকার তাগিদে প্রবাসে অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। ২০০২ -২০০৬ কার্যকালে জামাত নির্ভর বিএনপি হাওয়া ভবনের চাপে পরে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতকে দুর্নীতির আখড়া বানায়। যেহেতু আমি ২০০৯-২০২৩ সরাসরি সম্পৃক্ত নই তাই জ্বালানি খাতের বহুবিধ অর্জনের পাশাপাশি ব্যার্থতার খতিয়ান এখানে দেয়া সমীচীন মনে করি না।তবে একটি কথা লিখতে দ্বিধা নেই ২০০০ থেকেই গ্যাস সেক্টর ক্রমান্বয়ে আমলা নির্ভর হয়ে পড়ায় সংকটে পড়তে শুরু করে। যোগ্য অভিজ্ঞ কারিগরি কর্মকর্তারা ক্রমান্বয়ে চাকুরী ছেড়ে প্রবাসী হতে থাকে। মেধা পাচার হওয়ার কারণে গ্যাস সেক্টরের দক্ষতা হ্রাস পায়। গ্যাস চাহিদা সরবরাহে ব্যাবধান বাড়তে থাকে। সকল কাজ বিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তী পর্ব গুলোতে ধারাবাহিক আসবে।
বিজিএসএল অভিজ্ঞতা
১৯৮২ মার্চ নাগাদ আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়ায় এবং আমাকে নিদৃষ্ট বিরতিতে কুমিল্লা চট্টগ্রাম করতে হওয়ায় আমার পক্ষে ওর প্রতি প্রয়োজনীয় যত্ন নেয়া সম্ভব ছিল না।আমার মা ফরিদপুর থেকে এসে কিছুদিন ছিলেন। তাই আমি ওকে ব্রাহ্মণবাড়িযা শশুর বাড়ি রেখে আসলাম। সেখানে একটি ফিনল্যান্ডের শিশু মাতা উন্নত মানের হাসপাতাল আছে। নিশ্চিত হয়ে সাময়িক ভাবে রোজিকে রেখে আসলাম। কুমিল্লা ফিরে সংবাদ পেলাম শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন মহোদয়কে প্রধান করে চট্টগ্রাম বিজিএসএল কার্যালয় সূচনা করা হয়েছে। আমাকে ,সাইফুল হোহো আরো কয়েকজনকে বদলি করা হলো। চেরাগী পাহাড় মোড়ে ডিসি হিলের পাশে বিশাল অফিস। একসময় বঙ্গোপসাগরে কর্মরত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কার্যালয় ছিল।মনে আছে সুবে সাদেক নাম একজন পিওন ,আলী নামের পাচক ,সাইফুল ,আমি ,প্রকৌশুলি আবু শহীদ আর একজন হিসাব রক্ষক সহ শুরু করি কার্যক্রম। আলাউদ্দিন মহোদয় কোম্পানির দ্বিতীয় প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে সদর দপ্তরে বেশি সময় থাকতে হতো আমি আর সাইফুল দায়িত্ব ভাগ করে নিলাম। বলা যায় বিন্দু থেকে বৃত্ত রচনার প্রথম কাজ শুরু করি. সাইফুল স্থানীয় বিধায় ওর অসুবিধা কম ছিল। আমি আর শহীদ অফিসের নিচ তলায় বেজমেন্টে মাদুর পেতে মশারি টানিয়ে রাত কাটিয়েছি কয়েক দিন। ধীরে ধীরে অফিস সরঞ্জাম দিয়ে গোছাতে এক মাস লেগে যায়। দিনের বেলা চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষত সীতাকুন্ড ,মিরেরসরাই এলাকার পাইপ লাইনের পথসত্ব যৌথ সার্ভে করতাম। মনে আছে গ্রামবাসী আমাদের তাজা সবজি সিম ,লাউ, টমেটো উপহার দিত. আমাদের সেগুলো পাচক আলী রান্না করে দিতো। আমরা পারি পাহাড়তলীতে বিয়ের আসরে আমন্ত্রনহীন অতিথি হয়ে উপাদেয় খাবার খেতাম। এই সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রকল্পের মালামাল খালাস কাজে বাবর ভাই অনেক সহায়তা করেন।
অচিরেই কোম্পানির প্রধান মিন্টু ,আমি , শাহাদাৎ আলী ,শহিদুল আবেদীন, গুলজার হোসেনকে প্রকল্প প্রধানের প্রতিনিধি করে বাখরাবাদ -চট্টগ্রামে গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণ কাজের অফিস আদেশ জারি করেন। সিয়াফুলকে দেয়া হয় কাপ্তাই পর্যন্ত পাইপ লিনের দায়িত্ব।প্রতিটি গ্রুপে আমাদের একজন করে ভিনদেশি পরামর্শক দেয়া হয়. গুলজার হোসেন আলমগীরকে দেয়া হয় মেইন লাইন ওয়েল্ডিং তদারকির কাজ , আবেদীন আমি যৌথভাবে রাইট অফ ওয়ে ক্লিয়ারিং গ্রেডিং কাজ তদারকি করি।পাশাপাশি আবেদীন পাইপলাইন রাপিং কোটিং এবং মেইন লাইক লোয়ারিং কাজ তদারকি করে। আমার দায়িত্বে ছিল ব্যাক এন্ড সব কাজ – নদী ,খাল, বিল ,জলাশয় ,সড়ক ,রেল পথ ক্রসিং , মেইন লাইন ভাল্ভ স্টেশন ,অফটেক নির্মাণ কাজ তদারকি পাইপ লাইনের ভাষায় স্পেশাল পয়েন্ট। শুরুতে ঠিকাদারের ক্যাম্প ছিল না।আমাদের সাথে নাজমুল ,জামিল , আমজাদ ,আবু শহীদ ,মাহবুব জামাল সহ কয়েকজন নবীন প্রকৌশুলি যোগদান করে।কিছু দিন পর আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে অন্য প্রকল্পে সরিয়ে নেয়া হয়।শাহাদাত ভাইকে ফৌজদারহাট সিটি গেট স্টেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ১৯৮২-৮৩ সালে দেশের পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিল না। দেশের প্রথম ২৪ বাসের ক্রস কান্ট্রি পাইপলাইন নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। অনুজ সহকর্মী আইনুল কবীর অনেক ভালো অবস্থায় একই পথসত্ব দিয়ে ফৌজদারহাট -ফেনী -বাখরাবাদ পাইপ লাইন নির্মাণ কালে ভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে।
সূচনায় সপ্তাহে প্রতিদিন কোম্পানি প্রধানের নেতৃত্বে ঠিকাদার পরামর্শক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হতো. শ্রদ্ধেয় চোধুরী মোহাম্মদ মহসিনের সভাপত্বিতে অনুষ্ঠিত সভায় পরম শ্রদ্ধেয় ডক্টৰ হাবিবুর রহমান ( পরামর্শক পিএলটির বাংলাদেশ প্রধান) ,বিদেশী পরামর্শক , ঠিকাদার প্রধান, কে বি আহমেদ, সালমান এফ রহমান এবং আমরা উপস্থিত থাকতাম। প্রথম সভায় আমাকে সভার কার্য বিবরণী লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়।আমি শুরুতে ডক্টর হাবিবুর রহমানের নির্দেশ এবং তত্ত্বাবধানে সভার কার্যক্রম শুরু করি।
ইতিমধ্যে ঠিকাদার নির্মাণ যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ নির্মাণ স্থল সীতাকুণ্ডের শীতলপুর নিয়ে যায়। সিদ্ধান্ত হয় ২৩ এপ্রিল ১৯৮২ শুরু হবে প্রথম ওয়েল্ডিং। দুপুর ঠিক এগারোটায় দুইজন সেরা ইটালিয়ান ওয়েল্ডার প্রথম ওয়েল্ডিং করে.আমরা সভায় অফিস ফিরে সভায় মিলিত হলে মহসিন ভাই জানান আমাদের আজ দুটি সুখবর বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম প্রকল্পের প্রথম ওয়েল্ডিং হয়েছে এবং একই সঙ্গে আমাদের প্রকৌশুলি সালেক সুফির প্রথম পুত্র সন্তান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম গ্রহণ করেছে। প্রথম সন্তান বুঝতেই পারেন। আনন্দের জোয়ার। সবাই আমাকে অভিনন্দন জানান। ফুল আর মিষ্টি। সভা হয়. সভার পরে মহসিন ভাই এবং হাবিবুর রহমান মহোদয় আমাকে কয়েকদিনের ছুটি অথবা প্রকল্পটি কিছুটা মোমেন্টাম পেলে যাওয়ার অপসন দিলেন। আমি জাতীয় স্বার্থে থেকে যাওয়ার সিদ্দান্ত নিলাম। তবে আমি টেলিফোন করে ব্রানহ্মণবাড়িয়া কথা বলি ,টেলিগ্রাম পাঠাই। বিশ্বাস করুন দেশের স্বার্থে আমি প্রথম সন্তান জন্মের পর ১৫ দিন প্রকল্পের কাজে নিবেদিত ছিলাম। আমি আমার প্রথম সন্তান খন্দকার সাহারাত শাহরিয়ার (শুভ্র )কে দেখি ১৫ দিন পরে।আমার সন্তানের জন্ম দিন আর বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম পাইপ লাইন টির নির্মাণ কাজ সূচনা একই দিনে বিধায় পাইপ লাইনটি আমার অনেক প্রিয়।
ইতিমধ্যে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় এমনিতেই প্রকল্পের ম্যাথ পর্যায়ের কাজ স্থগিত হয়।আমাকে সাময়িক ভাবে কুমিল্লা থাকার অনুমতি দেয়া হয়।
চলবে।