সালেক সুফী।।
কিশোর পেরিয়ে যখন যৌবনের দুয়ারে তখন বাংলাদেশিদের জীবনে সুযোগ এসেছিলো গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার। খুব কাছে থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি ,যৎকিঞ্চিৎ অবদান রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধে ঘনিষ্ট বন্ধু সহ আত্মীয় পরিজন হারিয়েছি। চাকুরী জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বুকে নিয়ে নিজেকে নিবেদন করেছি। ২০০৫ সালে যুদ্ধাপরাধী জামাতকে সঙ্গী করে বিএনপি যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন হাওয়া ভবন বিরাগ হয়ে রাস্ত্রধারী অজুহাত দিয়ে চাকুরিচ্যুত করে জীবিকার অনু সন্ধানে প্রবাসে পারি জমিয়েছি। যারা আমাকে জানেন ছিলেন তারা বলবেন আমি বাংলাদেশকে জীবনের চেয়েও ভালোবাসি। দেশের কাজকে আমি এবাদত মনে করেছি। যাহোক জীবনের বালুকা বেলায় কিছু কথা নতুন প্রজন্মের কাছে নিবেদনের সুযোগ এসেছে। পর্যায়ক্রমে লিখছি তাই।
১৯৭৭ থেকে ২০০৫ নিরবছিন্ন ভাবে ২৮ বছর বাংলাদেশের গ্যাস সেক্টর এনার্জি সেক্টরের অনেক মাইল ফলক অর্জনের ক্ষুদ্র অংশীদার ছিলাম। তিতাস গ্যাস থেকে কর্ম জীবন শুরু , বিজিএসএল অভ্যুদয় এবং বিকাশে ছিলাম ভোরের পাখি , সিলেট গ্যাস ফিল্ডে ব্যাবস্থাপক উৎপাদন হিসাবে বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র তেলের কূপ পরিচালনা করার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির জরুরি প্রয়োজনে কাজ করার পর ফিরে এসে বিজিএসলে ১৯৯০-১৯৯৪ কোম্পানির পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করা অবস্থায় পেট্রোবাংলার প্রয়োজনে নবগঠিত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিতে বদলি করা হয়। জিটিসিএলেও ভোরের পাখি হিসাবে সাদ্ধমত অবদান রেখেছি। পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে , বিজিএফসিএল , বাপেক্স এমনকি বড়পুকুরিয়া খনির বিভিন্ন কাজেও সময় সময় পেট্রোবাংলার নির্দেশে কাজ করেছি। জিটিসিএলে কাজ করার সময় পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি হয়ে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি ইউনোকোল ,শেভ্রন, কেয়ার্ন এনার্জির কাজ তদারকি করেছি। দেশে ,বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে গ্যাস সেক্টরকে প্রতিনিধিত্ব করেছি সর্বোচ্চ সততা এবং কাজকে উপাসনা ভেবে। ২০০৫ সালে যখন জামাত বিএনপি সরকার ক্ষমতায় তখন আমাকে দেশদ্রোহী অপবাদ দিয়ে চাকুরিচ্যুত করা হলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরিমণ্ডলে ২০০৫-২০২৩ নানা কাজ করছি। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরে অবদান রাখতে চেষ্টা করছি।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকে আমার কাছে আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। ভাবলাম যদি আমার অভিজ্ঞতা থেকে আজকের তরুণরা দেশের হয়ে কাজ করতে কিছুটা উৎবুদ্ধ হয় তাহলে জ্বালানি সেক্টরের বর্তমান নাজুক অবস্থায় কিছু কাজে লাগবে। আমি কয়েকটি পর্বে আমার অভিজ্ঞতা আপনাদের কাছে তুলে ধরবো। আমার কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ অনুযোগ নেই। মহান আল্লাহ তালার কাছেই বিচার দিয়েছি। উনি আমাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেরা পেশাদারদের সাথে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। জ্বালানি এবং খেলাধুলা বিশেষত ক্রিকেট নিয়ে প্রচুর লিখি। সব সময় কিছু করতে চেষ্টা করি।অস্ট্রেলিয়ায় অবসর জীবনে জীবন সাথী ,দুই ছেলে , নাতিদের নিয়ে পরিতৃপ্ত জীবন যাপন করছি।
আশা করি আমার স্মৃতি আমাকে বঞ্চিত করবে না।
স্কুল কলেজ জীবন।
আমরা ফরিপুরের অধিবাসী। বাবা সরকারি চাকুরে। মা স্বশিক্ষিত হলেও ছিলেন বিদুষী রমণী। আরবি ফারসির পাশা পাশি বাংলায় ছিল অসামান্য দক্ষতা। বাবা ১৯৬৯ এবং মা ১৯৯৪ আমাদের ইয়াতিম করে গেছেন। আমরা ৩ ভাই দুই বোন।সবাই উচ্চ শিক্ষিত। বড় ভাই, বড় দুই বোন পরপারে। বেঁচে আছি আমি আর ছোট ভাই।
ফরিদপুরে অম্বিকা রোডে আমার বাবা ইফ্ফাত মঞ্জিল ক্রয় করে সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। সবুজ শ্যামল ফরিদপুরে স্কুল কলেজ জীবন কাটে। ১৯৬০ দশকে ফরিদপুর ছিল সাহিত্য সংস্কৃতির পাদপীঠ , খেহাধূলোয় ছিল অগ্রণী। আমরা সব ভাইবোন সব কিছুই করতাম। স্কুলে ছিলাম সেরাদের সেরা। পাশের বাসার প্রতিবেশী নাসিম ,তসলিম ,সেলিম ,শামীম ছিল আমাদের হরিহর আত্মা। আমাদের পাড়ায় ছিল পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের শহরের বাড়ী , বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমদের পারিবারিক বাড়িটিও ছিল কাছে। কাজী পরিবারের ভাইরা ,আমরা দুই ভাই, শাহীন , বাঁকা ,রাকা ,খুদুকে নিয়ে আমাদের ফুটবল ,ক্রিকেট টিম হয়ে যেত। মাঝে মাঝে ইরানি ,আরবি খেলতো আমাদের দলে। মাছ ,ধরা , ঘুড়ি উড়ানো , মার্বেল খেলার নেশাও ছিল. তবে লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলাম বলে খুব একটা অসুবিধা হয় নি. যদিও ছিলাম ডানপিটে।
স্কুল জীবন থেকেই স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে চ্যালেঞ্জিং সেক্টরে কাজ করবো। ফরিদপুর জিলা স্কুলে পড়ার সময় থেকে রসায়ন ,আর অংকে বেশ দক্ষতা ছিল। ফরিদপুরে অংকের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক শ্রদ্ধেয় তারাপদ স্যারের খুব প্রিয় ছিলাম। বাবা পরপারে চলে যাবার মাসখানেক পরে ১৯৬৯ এসএসসি পরীক্ষায় ৫ টি লেটার নিয়ে ষ্টার মার্ক্স্ পেয়েছিলাম। ১৯৬৯ রাজেন্দ্র কলেজেও ভালো ছাত্র ছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ জীবনের বাক বদল করে দেয়। কাছে থেকে সম্পৃক্ত হয়ে অনেক প্রিয় অপ্রিয় ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। আমার দুইজন ঘনিষ্ট বন্ধু ,খেলার সাথী নাসিম আর নওফেল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়। আমাদের অনেক কমন স্বপ্ন ছিল।বাংলাদেশে চাকুরী জীবনে সকল কাজেই ওদের স্মরণ করেছি।
যাহোক মুক্তিযুদ্ধ শিক্ষা জীবন থেকে একটি বছর পিছিয়ে দেয়। অনুসেচনা নেই আমরা স্বাধীন একটি দেশ অর্জন করি।১৯৭২ এইচ এসসি পরীক্ষায় লেটার নিয়ে পাশ করার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হয়ে ১৯৭৭ সালে কেমি কৌঁসুলি হিসাবে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করি
চলবে।