সালেক সুফী।।
স্মরণাতীত কালের সবচেয়ে গরম এবার বাংলাদেশে। মরুভূমির লু হাওয়া বইছে নগর , শহর জুড়ে। এরই মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ বিহীন বিনিদ্র রাত কাটছে রোজার এই শেষ সময়ে। নগরীগুলোতে গ্যাসের সংকট তীব্র। শুনছি সেচ কাজেও এখন বিদ্যুৎ সংকট। অথচ বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৫,৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে কয়েকদিন আগে। হিসাবে কোথাও কি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে? সেচ মৌসুমের শুরুতে এমনকি রোজার প্রথম দিকেও কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিশ্বজোড়া উষ্ণায়নের পথ ধরে যেই না তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ হলো।এবারের গ্রীস্ম এসেছে রোজা এবং নিবিড় সেচ কাজ সঙ্গী করে। হিসেব নিকেশ করেই বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছিল এবারের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৫০০০ -১৬০০০ মেগাওয়াট পৌঁছালেও সেটা সামাল দিতে সব প্রস্তুতি নেয়া আছে। মুখপাত্র পাওয়ার সেল মহাপরিচালক মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন এবারের মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেক স্বস্তিদায়ক হবে। নিবিড় সেচ সময় এবং রোজার অধিকাংশ সময় খুব একটা সমস্যা হয় নি। কিন্তু রোজার শেষ দশদিন যখন রোজাদাররা দোজখের আগুন থেকে নাজাতের জন্য এবাদত মশগুল থাকেন তখনি এখন বাংলাদেশ জুড়ে নরক যন্ত্রনা।
ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় দিনে রাতে ৮-১০ ঘন্টা লোড শেড্ডিং চলছে। গরমে অতিষ্ঠ মানুষ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। ঈদের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। তাপমাত্রা না কমা পর্যন্ত ভোগান্তি কমবে না বলে মন্তব্য করেছে বিদ্যুৎ খাত-সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববাজারে অগ্নিমূল্যের কারণে ২০২২ জুলাই থেকে স্পট মার্কেট এলএনজি কেনা স্থগিত করেছিল সরকার। তাই জুলাই থেকে নভেম্বর তীব্র গ্যাস সংকট ছিল দেশ জুড়ে। বিশ্ব বাজারে দাম কমে আসায় ফেব্রুয়ারী থেকে এলএনজি কিনতে শুরু করেছে সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ অনেক উন্নত হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি আমদানিকৃত কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। ভারতের আদানী গ্রুপের বিতর্কিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেও বিদ্যুৎ আসছে। সরকার ঘোষণা মতে গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২৫৬৬ মেগাওয়াট। তাহলে ১৫০০০ মেগাওয়াট চাহিদা মেটাতে কেন সংকট ? তাহলে কি বিতরণ ব্যাবস্থায় গলদ আছে ? নাকি সরকারি তথ্যে গরমিল?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে শনিবার ৪ হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট এবং কেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ২ হাজার ৬৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে দিনে কমপক্ষে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট। এ ছাড়া বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের ত্রুটির কারণে প্রায় বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।
জানিনা ডলার সংকটে তেল , কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে কিনা। কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন ডলার সংকট কেটে গাছে। তাহলে কয়লা এবং তেল ব্যাবহারকারী প্লান্ট গুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালানোর অসুবিধা কোথায়? বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা যে নাজুক তা নিয়ত অগ্নি সংকট থেকে অনুমান করা যায়. অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগছে। বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যাপারে কেউ কোনো নিরাপত্তার ধার ধরছে না। বিদ্যুৎ সেবা প্রধানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর মনিটরিং অপর্যাপ্ত। জনগণের সচেতনতার অভাব।
জানিনা কবে জাতি সার্বিক অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি পাবে ? আপাতত বৃষ্টির প্রার্থনা ছাড়া মুক্তি নেই।
ঢাকার বাইরে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মুখপাত্রের সূত্রে জানা গাছে , কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় তাঁরা লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছেন। খুলনার কয়রা উপজেলার কালনা বাজারের ব্যবসায়ী মহসীন মোল্লা জানান, দিনে-রাতে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে দোকানের ফ্রিজে রাখা মালপত্র নষ্ট হচ্ছে।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন নগরীর বর্ধিত অংশে দু’দিন ধরে বিদ্যুৎ শুধু যাচ্ছে আর আসছে। রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন বলেন, আধা ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় ঈদের আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশের মিডিয়ার খবর জানাচ্ছে
কুড়িগ্রামে এক সপ্তাহ ধরে দিনে ও রাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। শহরের গাড়িয়ালপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বলেন, রোববার সেহরির খাবার খাওয়ার সময় ৪টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। পরে ফজরের নামাজ পড়ার সময় বিদ্যুৎ আসে। আবার বিকেল ৫টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। জেলা হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসারত রোগীর স্বজন জ্যোৎস্না বেওয়া বলেন, ‘সকাল থাকি কারেন্ট নাই। রুমের বাইরে গাছের বাতাসও নাই। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছি। খুব গরম।’
ফরিদপুরে শনিবার রাত ১১টা থেকে এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। রোববারও দিনভর একই নিয়মে চলে লোডশেডিং। বাগেরহাটে দিনে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। নড়াইলের কালিয়ার গ্রামগুলোতে শনিবার লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ দুর্ভোগ পোহালেও পৌরসভার বাসিন্দারা স্বাভাবিক বিদ্যুৎসেবা পেয়েছেন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ১৫-২০ মিনিট থেকে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। একবার গেলে আর আসার নাম নেই। রোববার ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টায় আটবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দৈনিক ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি দুই ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং করছে। ঝিনাইদহের অধিকাংশ এলাকায় ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চার-পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না।
ঢাকায় এলাকাভেদে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, তাঁর এলাকায় সরবরাহজনিত কারণে এখনও লোডশেডিং হয়নি। তবে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ ও সঞ্চালন সমস্যার কারণে লোডশেড করতে হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
জানি কর্তৃপক্ষ বলবেন পরিস্থিতি আঁচ করা যায় নি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যানে আবহাওয়ার আগাম পূর্বাভাস জানা যায়। বাংলাদেশের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল স্বীকার করতেই হবে।যখন কোনো পরিকল্পনা করা হয় তখন বিকল্প সংস্থান রাখা হয়। বিদ্যুৎ সেক্টরের বিকল্প কোনো পরিকল্পনা ছিল কি? ওনারা কি বলতেন পারবেন বাংলাদেশের প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা কত? নাহলে এমন বিড়ম্বনা হতেই থাকবে। এদিকে আবার বিশ্ব জ্বালানি বাজার অস্থির হয়ে পড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনের বছরে জ্বালানি সংকট মেটানো সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
গরমে হাঁসফাঁস , বিদ্যুৎ সংকটে ত্রাহি মধুসুধন অবস্থা , গ্যাসের অভাবে রান্নায় সংকট। ত্রিমুখী সংকটে নুজো বাংলাদেশিরা।