ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারতে পালানোর আগে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট সকালে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ফোন করে ঢাকার ওপর দিল্লির হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। দিল্লির সহায়তা চাওয়ার আগে তিনি দেশে সামরিক শাসন কিংবা জরুরি অবস্থা জারির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ, বাংলাদেশের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুব গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সমন্বয় করে ৪ আগস্টের মধ্যেই পরিকল্পনাটি তৈরি করেন। পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন এসএসএফের ডিজি মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান এবং সেনাবাহিনীর কিউএমজি লে. জেনারেল মুজিব।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শেখ হাসিনা ৪ আগস্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ফোন করে জরুরি অবস্থা জারির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন গুলিবর্ষণ করে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনের। তেমনি বিমানবাহিনী প্রধানকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালাতেও বলেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার কোনো অভিপ্রায় বা হুকুম তামিল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণরক্ষার জন্য স্যুটকেস গুছিয়ে নিরাপদ অবস্থানে যেতে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। গণভবনে দুপুরের খাবার রান্না করা ছিল। কিন্তু খাওয়ার সময়ও ছিল না। বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় তিনি ১৪টি স্যুটকেস সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং স্যুটকেসগুলো ঠিকঠাকভাবে বিমানে উঠেছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বিমানে করে আরও পালিয়েছেন তার বোন শেখ রেহানা, জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী এবং একটি শিশু মেয়ে।

‘শেখ হাসিনা পালায় না’ এই দম্ভোক্তির দশ দিনের মাথায় শেখ হাসিনা এভাবে পালিয়ে যান ভারতে। সাড়ে পনেরো বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় টিকে থাকা একজন প্রধানমন্ত্রী এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন, এটা কেউ ভাবতেই পারেননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তার নজির নেই।

শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং ৩ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণভবন ও ঢাকা সেনানিবাসে কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় আমার দেশ। গণভবনের প্রত্যক্ষদর্শী নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সেনা ও বিমানবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ও বঙ্গভবন সূত্রে এবং কয়েকজন উপদেষ্টার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে অজানা সব কথা বেরিয়ে আসে। বিষয়গুলো স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে নাম উল্লেখ করা হয়নি। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে শেখ হাসিনার অন্তত দুবার কথা হয়। দোভাল অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেন এবং শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে ভারতীয় সেনাপ্রধান টেলিফোনে কথা বলেছেন বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে।

যেভাবে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা তেজগাঁও কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ বিমানে করে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ফ্লাই করেন। বিমানটির পাইলট ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামীম রেজা ও উইং কমান্ডার গোলাম রসূল চৌধুরী।

গণভবন থেকে গাড়িতে করে কুর্মিটোলা যাওয়ার জন্য প্রথমে জেদ ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তাকে নিষেধ করা হলেও গাড়িতে ওঠেন এবং গাড়িবহর গণভবন থেকে কুর্মিটোলার উদ্দেশে যেতে থাকে। গাড়িবহরের অগ্রগামী ক্লিয়ারিং অফিসার (কর্নেল পদমর্যাদার) জানান, সামনে বড় মিছিল আছে, গাড়িবহর নিয়ে যাওয়া যাবে না। তখন গাড়িবহরে থাকা এসএসএফের একজন অপারেশন অফিসার বলেন, ‘আমরা গুলি করে করে এগিয়ে যাব।’ কিন্তু গাড়িবহরে থাকা জুনিয়র অফিসাররা বলেন, ‘ঝুঁকি নেওয়া আমাদের ঠিক হবে না। মবের সামনে পড়লে সবাই মারা যেতে পারি। ফলে গাড়িবহর ঘুরিয়ে গণভবনের পেছনে বাণিজ্যমেলার মাঠে (আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পশ্চিম পাশে) নেওয়া হয়। এরই মধ্যে রাশিয়ার তৈরি হেলিকপ্টার (এমআই-১৭) কল করে এনে প্রস্তুতও রাখা হয়। হেলিকপ্টারে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী এবং একটি মেয়েশিশু (সম্ভবত তারেক সিদ্দিকীর পরিবারের হতে পারে)। হেলিকপ্টারটি সেখান থেকে কুর্মিটোলায় যায়। পাইলট ছিলেন এয়ার কমোডর আব্বাস ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন রায়হান কবির। হেলিকপ্টারটি ১২টা ৩০ মিনিটে কুর্মিটোলায় পৌঁছালে বেস কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে থাকা এয়ার ভাইস মার্শাল এবিএম আউয়াল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রিসিভ করেন। এ সময় উইং কমান্ডার জাকি আনোয়ার গণভবন থেকে সঙ্গে আনা শেখ হাসিনার ১৪টি স্যুটকেস বিমানে উঠিয়ে দেন। এ সময় শেখ হাসিনা কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। শুধু স্যুটকেসগুলোর খোঁজ নেন, সবগুলো বিমানে উঠেছে কি না। সঙ্গে বিমানে আরও ওঠেন ডিজি এসএসএফ, এসএসএফের তিন থেকে চারজন কর্মকর্তা এবং ফ্লাইট লে. পদবির একজন লেডি কর্মকর্তা। কুর্মিটোলা পৌঁছার ১০ মিনিটের মধ্যেই শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তারেক সিদ্দিকীকে নিয়ে বিমানটি উড্ডয়ন করে। এ সময় সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমানের ওঠানামা বন্ধ করে দেয়। ‘সি-১৩০ জে’ বিমানটি ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে উড্ডয়ন করে, যাতে রাডারের সঙ্গে যোগাযোগ সংযোগ না হয়। সাধারণত বিমান উড্ডয়ন করে নর্থবেঙ্গল হয়ে ঘুরে যায়। কিন্তু এ বিমানটি আকাশে উঠেই নর্থবেঙ্গলে না গিয়ে ত্রিপুরার (আগরতলা) দিকে চলে যায়, যাতে খুব অল্প সময়ে সীমান্ত পার হতে পারে। এরই মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে বিমানটি সরাসরি দিল্লি চলে যায় এবং নামে দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে। সেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। জানা গেছে, হাসিনা সেখানেও অজিত দোভালকে ঢাকায় আক্রমণ করতে বলেন। শেখ হাসিনাকে হিন্দন ঘাঁটিতে নামানোর পর রিফুয়েলিং করে বিমানটি কর্মকর্তাদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এর আগেও দফায় দফায় ঢাকায় এসেছেন। বিশেষ বিমানে করে তিনি আসতেন। গণভবনে যেতেন কিন্তু তার আসা-যাওয়ার কথা গোপন রাখা হতো।

কঠোর গোপনীয়তায় পালানোর পরিকল্পনা

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে আমার দেশ নিশ্চিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তৎকালীন এসএসএফের ডিজি মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান এবং সেনাবাহিনীর কিউএমজি জেনারেল মুজিব হাসিনার পালানোর পরিকল্পনা করেন। জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী এ ব্যাপারে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের প্রয়োজনীয় গাইডলাইন নেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কোনো বিমানে করে যেতে চাচ্ছিলেন না। তিনি ভারত থেকে বিমান এনে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে দেশের কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারত বিমান পাঠাতে পারবে না। এটা করা হলে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস সৃষ্টি হবে। এরপর সিদ্ধান্ত হয় বিমানবাহিনীর বিমানে করেই শেখ হাসিনা পালাবেন। আরও সিদ্ধান্ত হয়, সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কিছু সময়ের জন্য অন্যান্য বিমান ওঠানামা বন্ধ রাখা হবে। রাডারে যাতে বিমানটি ধরা না পড়ে, সে জন্য এর ট্রান্সপন্ডার অফ রাখা হবে। এছাড়া বিমানটি ফ্লাই করার আগে যাতে খবরটি ‘লিক’ হয়ে না যায় এবং শেখ হাসিনার গতিবিধি যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য আগে থেকেই ইন্টারনেটও বন্ধ রাখা হয়। ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কিংবা গোপালগঞ্জে যাচ্ছেন বলে দুটি খবরও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভারতে পালিয়ে যাচ্ছেন- এই আসল খবরটি যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্যই এভাবে প্রতারণা করে দৃষ্টি অন্যদিকে নেওয়ার চিন্তা করা হয়।

গণভবনে কী ঘটেছিল

গণভবনে ৪ আগস্টের রাতটি ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ংকর। ওই রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কয়েক দফা বৈঠক হয়। তিনি বৈঠক করেন মন্ত্রী, দলের শীর্ষ নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে। বৈঠকে রাগারাগি ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।

রাত ১২টা থেকে সোয়া ১২টার দিকে তিন বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী। সে বৈঠকে পদত্যাগের বিষয়টি ওঠানো হলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন, যা হওয়ার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানকে মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের জন্য বারবার বলতে থাকেন। জেনারেল তারেক সিদ্দিকী শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বলতে থাকেন, সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোককে মেরে ফেললে বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে। বিমানবাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথাও তিনি বলেন। এমন পরিস্থিতিতে বৈঠকে উপস্থিত বিমানবাহিনীপ্রধান তারেক সিদ্দিকীর ওপর ভীষণ রেগে যান এবং প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, এই লোকটিই আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডোবাবে। ঠিক এ সময় একজন অপরিচিত ব্যক্তি (যাকে ডিউটিরত এসএসএফ সদস্যরা চেনেন না) গণভবনে প্রবেশ করলে শেখ হাসিনা সভা শেষ করে দেন। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে তিন বাহিনীপ্রধান গণভবন ত্যাগ করেন। রাতে গণভবনে পুলিশের আইজি আবদুল্লাহ আল মামুন এবং এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) জামালউদ্দিনও ছিলেন।

৫ আগস্ট সকাল ৯টায় তিন বাহিনীপ্রধান আবার গণভবনে আসেন। এ সময় পুলিশের আইজি এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমানও গণভবনে ছিলেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের আইজি আবদুল্লাহ আল মামুনকে দেখিয়ে বলেন, ওরা (পুলিশ) ভালো কাজ করছে। সেনাবাহিনী পারবে না কেন? এ সময় পুলিশের আইজি বলেন, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এ রকম কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের আর কিছু করার সামর্থ্য নেই। অস্ত্র, গোলাবারুদ আর অবশিষ্ট নেই। ফোর্সও টায়ারড হয়ে পড়েছে।

সামরিক কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী রেগে গিয়ে বলেন, তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেল এবং গণভবনে কবর দিয়ে দাও। সামরিক কর্মকর্তারা শেখ রেহানাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে রাজি করাতে অনুরোধ করেন। তারা এ কথাও বলেন যে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির কারণে গণভবন অভিমুখে ঢাকার চারপাশ থেকে মিছিল আসছে। এ পর্যায়ে শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা চালান। একপর্যায়ে বড় বোন শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরেন রেহানা। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজি হচ্ছিলেন না। পরে জয়ের সঙ্গে কথা বলেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। জয়কে বলা হয়, প্রাণে বাঁচাতে হলে তার মাকে পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। টাইম একটা ফেক্টর। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জয় পরিস্থিতি জানার পর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। অবশেষে জয়ের কথায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। তিনি টেলিভিশনে প্রচারের জন্য একটি ভাষণ রেকর্ড করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সামরিক কর্মকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাগ গোছাতে ৪৫ মিনিটের সময় দেন। কারণ গণভবন অভিমুখে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার যে মিছিল আসছে, সে সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ছাত্র-জনতার এই স্রোত ছিল ৩৬ দিনের অভাবনীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ- চব্বিশের বিপ্লব, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান।

বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় ৩ আগস্ট

‘সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করবে না’- ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান এ কথা জানিয়ে দেওয়ার পরই মূলত শেখ হাসিনার রাজত্বের বিদায়ঘণ্টা বেজে যায়।

ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশব্যাপী সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। আন্দোলন পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ফিডব্যাক নিতে ওইদিন সেনাসদরে বিভিন্নস্তরের সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মতবিনিময় করেন। দেশের অন্যান্য ফরমেশনের কর্মকর্তারাও ভার্চুয়ালি ওই সভায় যোগ দেন। শুরুতে আধঘণ্টার একটি উদ্বোধনী বক্তৃতা করেন সেনাপ্রধান।

তিনি সরকারের নির্দেশনায় সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় কেন সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন। সভায় তিনি এ কথাও বলেন, ‘আমাদের দেশে ১৯৭০ সালের পর এমন গণবিক্ষোভ আর কখনো হয়নি। তাই আমাদের এই পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর উপস্থিত কর্মকর্তাদের বক্তব্য আহ্বান করা হয়। বক্তব্যের জন্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং এর চেয়ে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা হাত তুললেও সেনাপ্রধান তরুণ কর্মকর্তাদের কথা শুনতে চান। সভায় সেদিন ছয় থেকে সাতজন কর্মকর্তা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা শোনান।

রাজশাহীর একজন নারী সেনাকর্মকর্তা বাংলায় আবেগপূর্ণ ভাষায় বলেন, দেশের সব মাকে মৃত্যু স্পর্শ করেছে এবং সব মা কাঁদছেন। তিনি মীর মুগ্ধর প্রতিবেশী ছিলেন, যে মুগ্ধ ঢাকার উত্তরায় ছাত্রমিছিলে পানি বিতরণ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। নারী কর্মকর্তা মেজর হাজেরা জাহান এ ঘটনায় শিশুদের প্রাণহানি ও এর ন্যায্য বিচার হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি সেনাবাহিনীর ওপরও অসন্তোষ বাড়তে থাকা নিয়ে উদ্বেগ জানান। সেনাপ্রধান তার মনোভাবের সঙ্গে একমত হন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি গুলির ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ক্যাপ্টেন বর্ণনা করেন সেদিন কীভাবে কর্তব্যরত সেনাসদস্যদের জনতা ঘিরে ধরেছিল এবং তিনি পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে সমালোচিত হয়েছিলেন।

তেমনি সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের সমর্থন কমে যাওয়ার কথা তুলে ধরে সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন পাঁচ এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মাহবুব। এ ধরনের বেশ কিছু বক্তব্য সভায় আসে।

সেনাপ্রধান কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনার পর সিদ্ধান্ত দেন, যে কোনো উসকানিতেও সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করবে না। শিক্ষার্থীদের মিছিলকে প্রতিহত কিংবা বাধা দেবে না। মিছিল চলাকালে সেনাসদস্যরা বরং সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেবে।

সেনাপ্রধান সভার এ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দেন। এ সিদ্ধান্তে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ হন। ৪ আগস্ট রাওয়া ক্লাবে অনুষ্ঠিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বৈঠকটিও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই বৈঠকে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নূরউদ্দিনসহ কয়েকজন প্রাক্তন সেনাপ্রধান উপস্থিত ছিলেন। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সেদিন মিছিলও করেছিলেন।

গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্পিকারের পরামর্শ

৪ আগস্ট দুপুরে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার বার্তা পৌঁছে দেন শেখ হাসিনাকে। তাকে অনুরোধ করেন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পদত্যাগ করার। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাকে শিরীন শারমিন চৌধুরী এ কথা জানান। তিনি এও জানান, তার পরামর্শ ও প্রবীণ নেতাদের বার্তায় শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু গণভবনে তখন উপস্থিত আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এর তীব্র বিরোধিতা করেন। রাতে ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে পরিচিত ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও আসাদুজ্জামান কামাল শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে নিয়ে যান। তারা হাসিনাকে বলেন, এখন কোনোভাবেই নরম হওয়া যাবে না, নতিস্বীকার করা যাবে না।

ভাষণ রেকর্ড করতে গণভবনে বিটিভির ওভি ভ্যান

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে ৪ আগস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিজিকে ফোন করে জানানো হয় শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ৪ আগস্ট রাতে ভাষণ রেকর্ড করার জন্য গণভবনে বিটিভির অভি ভ্যান টিম পাঠানো হয়। ৫ আগস্ট সকালে বিটিভির স্ক্রলেও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারের কথা দেখানো হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় আইএসপিআর থেকে বিটিভির মহাপরিচালককে জানানো হয়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বেলা ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। আইএসপিআর থেকে অভি ভ্যান চাওয়া হলে বিটিভি থেকে বলা হয়, অভি ভ্যান গণভবনে রয়েছে, সেখান থেকে নেওয়া সহজ হবে। সেনাপ্রধানের সেই ভাষণ প্রচার করা হয় বিকাল ৪টায়।

রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা জারির জন্য তৈরি থাকা

বঙ্গভবন সূত্রে জানা গেছে, ৪ আগস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ফোন করে জানান, দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে, তিনি যেন তৈরি থাকেন। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সেক্রেটারি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারিকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী যে কোনো সময় বঙ্গভবনে আসতে পারেন।

Please follow and like us:
0
fb-share-icon20
Tweet 20
Pin Share20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Enjoy this blog? Please spread the word :)

Facebook20
YouTube20
Instagram20
20