সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে শুক্রবারেও শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল সোয়া পাঁচটায় মিছিল শেষে আন্দোলনের মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠা এই মোড়ে অবস্থান নেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। বৃহস্পতিবার চলমান আন্দোলনে বাধা ও হামলার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক অবরোধের পর শাহবাগ ছাড়েন আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়াও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও। টানা তৃতীয় দিনের মতো শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন কয়েকশ’ শিক্ষার্থী। চারদিন আধাবেলা, একদিন সর্বাত্মক ব্লকেড কর্মসূচি ও গতকাল একঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকে শাহবাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, এসময় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকলেও বৃহস্পতিবারের মতো তাদের কোনো ধরনের তৎপরতা চোখে পড়েনি। শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে শাহবাগ ও এর আশপাশের সড়কে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
সেখানে তারা ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’, আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আঠারোর পরিপত্র-পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক-মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘সারা বাংলায় খবর দে-কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘আমার সোনার বাংলায়-বৈষম্যের ঠাঁই নেই’, ‘জেগেছে রে জেগেছে-ছাত্রসমাজ জেগেছে’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত রাখতে কর্মসূচিতে বক্তব্যও রাখেন অনেকে।
পরে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। তিনি বলেন, সারা দেশে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা হয়েছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে। পুলিশ এক সাংবাদিককে লাঠি দিয়ে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আমরা এই হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।
বাকের বলেন, আমরা শনিবার (আজ) সারা দেশের আন্দোলন সমন্বয়কদের সঙ্গে অনলাইন, অফলাইনে বৈঠক করে সমন্বয় করবো। পাশাপাশি গণসংযোগ চলমান থাকবে। সবশেষে সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সার্বিক বিষয়ে একটি প্রেস ব্রিফিং করা হবে। কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই শেষ হয় অবরোধ কর্মসূচি।
এর আগে বিকাল ৪টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ডিপার্টমেন্টের ব্যানারে স্লোগান ও মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকেন তারা। দেন নানা স্লোগান। পরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদিক্ষণ করে শাহবাগ মোড়ে এসে জড়ো হন।
রোববার থেকে ফের কঠোর কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নেতৃত্বে থাকা একটি সূত্র মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছে রোববার থেকে ফের কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ারই পরিকল্পনা আছে তাদের। সূত্রটি জানায়, চলমান কঠোর কর্মসূচি থেকে ফিরে আসার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের। শুক্র-শনিবার টানা আন্দোলনের ভেতরে থাকা শিক্ষার্থীদের কিছুটা বিশ্রামের জন্য বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি। তবে রোববার থেকে ফের ব্লকেডের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া হতে পারে। তবে সরকার যদি এর মধ্যে কোটা সংস্কারের ইতিবাচক কোনো ঘোষণা দেয় তাহলে রোববার থেকে শিক্ষার্থীরা আর মাঠে নামবে না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাকৃবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিকাল সাড়ে ৫টায় মুক্তমঞ্চ থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ মিছিলে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।
এসময় বক্তারা বলেন, যদি এই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি না দেয়া হয়, তবে তারা আরও কঠোর আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হবে। এই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন বলে জানান তারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্র সমাবেশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে নগরীতে জড়ো হয় প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী।
শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে চট্টগ্রামের ষোলশহর স্টেশনে একত্রিত হয় শিক্ষার্থীরা। পরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরীর ২ নম্বর গেট হয়ে চকবাজারের দিকে যান কোটা সংস্কারপন্থিরা। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা বলেন, বৃহস্পতিবার শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমাদের ওপর পুলিশ ন্যক্কারজনকভাবে হামলা চালিয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) প্রতিনিধি জানান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ ও জড়িতদের বিচারের দাবিতে বুকে কালোব্যাজ ধারণ করে বিক্ষোভ ও ছাত্র সমাবেশ করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটার দিকে তারা এই কর্মসূচি করেন। শিক্ষার্থীরা জানান, আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি আমাদের আন্দোলনরত ভাই-বোনদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, গায়ে হাত তোলা হয়েছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সারা দেশে চলমান শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না। হামলা করে শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখা যাবে না।
বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও (বেরোবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্মারকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পরে বিক্ষোভ মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ১নং গেটে এসে শেষ হয়। এসময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, বেরোবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা প্রতিবাদ জানাই। একটা যৌক্তিক আন্দোলনের দাবিতে আমরা রাজপথে নেমেছি। আমাদের দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়বো না।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিনিধি। শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টায় মুক্তমঞ্চ থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ মিছিলে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি ক্যাম্পাসের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে কামাল-রঞ্জিত (কে আর) মার্কেট হয়ে আব্দুল জব্বার মোড়ে এসে শেষ হয়। এরপর বৃষ্টি উপেক্ষা করে সেখানে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস।
আন্দোলনকারীরা বলেন, যদি এই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি না দেয়া হয়, তবে তারা আরও কঠোর আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হবেন। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে তাদের ওপর পুলিশি হামলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) সংবাদদাতা জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানান তারা। এদিন গত কয়েকদিনের চেয়ে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
শুক্রবার বেলা ৫টায় লাইব্রেরি থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের সেকেন্ড গেট হয়ে বিভিন্ন মহাসড়ক প্রদক্ষিণ করে। এসময় শিক্ষার্থীরা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংযোগ সড়ক, আগারগাঁও, শিশুমেলা, কলেজগেট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল মোড়ে অবস্থান নেন। এসময় ভুয়া ভুয়া স্ল্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রতিনিধি জানান, তৃতীয় দিনের মতো ঢাকা-রাজশাহী রেল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৫টায় স্টেশন বাজার সংলগ্ন রেল সড়ক অবরোধ করেন তারা। রাত ৮টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ ছিল রেলপথ।