নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে মডেল পিএসসি-২০২৩ (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা সফর শেষে দেশে ফিরলেই উপস্থাপনা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এদিকে দরপত্রের জন্য গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি ব্লক প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা গেছে।
মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রেজেন্টেশন সংক্রান্ত চিঠি আমরা পেয়েছি। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই বিস্তারিত উপস্থাপনা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, মে মাসের মধ্যেই মডেল পিএসসি-২০২৩ (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) চূড়ান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদন করিয়ে গভীর সমুদ্রে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
সূত্র মতে, পিএসসি সংশোধনীর উপর নির্ভর করছে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ভবিষ্যত। দেশের ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের স্বস্তিকর সমাধান এই বিশাল জলরাশির নিচে লুকায়িত বলে ধারণা করা হয়। তবে সেই বিশাল সমুদ্রসীমা পেট্রোবাংলার ঢিলেমির কারণে এখনও অধরা। ২০২০ সালের নভেম্বরে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় মডেল পিএসসি হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ওই সিদ্ধান্ত জানুয়ারিতে (২০২১) প্রেরণ করা হয় পেট্রোবাংলায়। রহস্যজনক কারণে প্রায় ১০ মাস সেই ফাইল চাপা দিয়ে রাখে পেট্রোবাংলা।
পরে ২০২২ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরের উড ম্যাকেঞ্জি এশিয়া প্যাসিফিককে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়। কোম্পানিটি চার মাস পর খসড়া জমা দিলে আবার ফাইল চালাচালি শুরু করে পেট্রোবাংলা। তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে নতুন সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার যোগদান করলে ফাইলটি গতি পায়। এরপর দ্রুততার সঙ্গে লেজিসলেটিভ বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের মতামত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করা হয়।
পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ অনেক ছাড় দিয়ে মডেল পিএসসি-২০১৯ (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) সংশোধিত করা হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তুলতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রডের দাম ৮০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৮ ডলার। যা বিদ্যমান পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল।
দামের পাশাপাশি সরকারের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গভীর সমুদ্রে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত উঠানামা করবে। সংশোধিত প্রস্তাবে গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে ৪০ থেকে ৬৫ উঠানামা করার কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। কিন্তু কোনো কার্যক্রম করতে পারেনি বাংলাদেশ। এর আগে ২০০৮ সালের গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা পেয়েছিল আমেরিকান কোম্পানি কনোকো ফিলিপস।
কোম্পানিটি দুই বছর অনুসন্ধান করার পর চুক্তি সংশোধন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দাবি জানায়। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক দরপত্রে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ফিলিপস ও স্টেট অয়েল।
পরবর্তী সময়ে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। একই সময়ে অগভীর সমুদ্র্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দর প্রক্রিয়া এসএস ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস ৪ ও এসএস ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নিয়েছিল।
সান্তোস এসএস-১১ ব্লকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করার পর কূপ খনন না করেই বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। ওএনজিসি দুই ব্লকে থ্রি-ডি ও টু-ডি সাইসমিক জরিপ চালানোর পর ৪ নম্বর ব্লকে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছিল; কিন্তু গ্যাস মেলেনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দর একটি বড় বিষয় হলেও এখানে রয়েছে তথ্যের ঘাটতি। সাগরের তেল-গ্যাস সম্পর্কে যেসব তথ্য রয়েছে এগুলো এক সময় উন্মুক্ত ছিল। কোন কোম্পানি চাইলে এসে কিনতে কিংবা দেখতে পারতো।
তারা সেগুলো যাচাই করে দরপত্রে অংশ নিতো। এখন ওই তথ্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যে কারণে বহুজাতিক কোম্পানি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উল্লেখ্য বাংলাদেশের পাশের ব্লকগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস উত্তোলন করছে মিয়ানমার। দাই বাংলাদেশ যতো বেশি বিলম্ব করছে ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।