সালেক সুফী।।
বিজিএসেলে বিদেশী প্রশিক্ষণ নিয়েও আঞ্চলিকতা হতো. কারিগরি প্রশিক্ষণে অকারিগরি কর্মকর্তাদের পাঠানো হতো। যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলিয়াম প্রশাসন নিয়ে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনিয়ো প্রশিক্ষণে কয়েকজন অকারিগরি কর্মকর্তাদের পাঠানো নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। যাহোক আমার এবং অলকেশ চৌধুরীর সিলেটে যথাক্রমে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস এবং জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে বদলির আদেশ স্থগিত থাকা অবস্থায় আমরা ১০ জন ( বিজিএসএল ৭ জন এবং জালালাবাদ গ্যাসের ৩ জন) মদ্ধম সারির প্রকৌশুলি ৮ সপ্তাহের প্রশিক্ষণে নেদারল্যান্ড গমন করি ১৯৮৮ জানুয়ারী মাসে। আমাদের সাথে ছিলাম আমি খন্দকার সালেক , শহিদুল আবেদীন, গুলজার হোসেন আলমগীর , মোহাম্মদ হাসান, জামিল মোহাম্মদ আলিম, সানোয়ার হোসেন চৌধুরী, রফিকুর রহমান এবং জালালাবাদ গ্যাসের আবুল কাসেম, জামিল এবং সাহাবুদ্দিন। এই প্রশিক্ষণটি নানা কারণেই আমাদের জন্য অনিচে নেক উপকারে এসেছে। আমি ছাড়া আবেদীন , জামিল, সানোয়ার , রফিক কোম্পানির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবং তিন জন পেট্রোবাংলার পরিচালক হয়েছে। আমি , শাহাবুদ্দিন , কাসেম , জালালাবাদের জামিল এখন প্রবাসে। গুলজার ভাই কানাডায় প্রবাসে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। হাসান অবসর নিয়ে বাংলাদেশে।
পশ্চিম ইউরোপ তখন শীত মৌসুম। আমরা বৃটিশ এয়ারওয়েজ যোগে লন্ডন হয়ে আমরাস্টার্ডাম শিফল বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি চারিদিক বরফ ঢাকা। ঢাকার ১৮-২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে -(২০-২৪ ) ডিগ্রী সেলসিয়াস। আমরা নিজেদের থেকেও আমাদের সঙ্গে থাকা গুলজার হোসেন আলমগীরের বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। ১৯৮৬ ইংল্যান্ডে আগের প্রশিক্ষণ থেকে ওনাকে একিউট ট্রপিকাল ডিসেন্ট্রির জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এইপোর্ট পৌঁছে দেখি প্রিয় সহকর্মী অবদান সহ আরো দুইজনের লাগেজ আসেনি। এই শীতে একমাত্র সম্বল পরনের কাপড় এবং আমাদের রিসিভ করতে আশা গ্যাস ইউনি বিভির অনা ডি জংয়ের সঙ্গে আনা মোটা জ্যাকেট ( সানোয়ার জামিল নাম দিয়েছিলো জ্যামকোট)। শিফল বিমানবন্দর থেকে আমাদের প্রশিক্ষণের শহর গ্রনিগেন ছিল চার মাইলের ড্রাইভিং দুরুত্বে। ছবির মতো দেশ হল্যান্ড। সাগর সময় তলের ২ মিটার নিচে থাকা দেশটি চারিদিকে ডাইক বেষ্টিত। টিউলিপের দেশ হল্যান্ডে আমাদের সময়টা আমাদের সবার জীবনে গভীর দাগ কেটেছিল।
১৯৮০,১৯৯০ হল্যান্ড ছিল পশ্চিম ইউরোপ গ্যাস সরবরাহের মূল উৎস. তখনও রাশিয়া থেকে পাইপ লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় নি।হল্যান্ডের শ্লোকতারেন গ্যাস ক্ষেত্র পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্র। এছাড়া নরওয়ে থেকে পাইপলাইন দিয়ে আনা গ্যাস হল্যান্ডের গ্যাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বেলজিয়াম , ফ্রান্স , সুইজারল্যান্ড , জার্মানি রপ্তানি হতো. গ্যাস সঞ্চালন বিষয়ে দীক্ষা নেয়ার জন্য গ্যাস ইউনি ছিল আদর্শ। আমরা শুরুর দিকে সাউথ লরেন এলাকায় বাংলো পার্কে থাকতাম। আমি ,আবেদীন এবং গুলজার ভাই এক বাসায়, হাসান, জামিল, সানোয়ার ,রফিক দ্বিতীয় বাসায় এবং জালাবাদের তিন বন্ধু তৃতীয় বাসায় থেকেছি। বাসা গুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক সব সুবিধা সম্বলিত ছিল. আমাদের প্রতিদিন ৭০ গিলডার দেয়া হতো যা সেই সময় প্রয়োজনের তুলনায় ছিল পর্যাপ্ত। হল্যান্ড মুরগী , দুধ ,আলুর জন্য বিশ্বখ্যাত। আমরা সকালের এবং রাতের খাবার নিজেরা রান্না করতাম। আমাদের তিন জনের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম। গুলজার ভাই ধোঁয়া ,মোছার কাজ করতেন, আবেদীন কাটাকুটি করতো আমি রান্না করতাম। প্রায় প্রতি দিন খিচুড়ি , মুরগির মাংস ,ডিম্ এবং বেগুন ভাজা খেতাম। দুধ খেতাম প্রচুর। দুপরে প্রশিক্ষণের সময় আমাদের উপাদেয় খাবার দেয়া হতো. আমাদের দুটি সেলফ ড্রিভেন গাড়ি দেয়া হয়েছিল। আবেদীন আমাদের গাড়ি চালাতো। আরেকটি গাড়ি চালাতো জামিল আলিম। কত যে মজার ঘটনা ঘটেছে এই সময়ে।
আমি কিন্তু ওই সময় নিয়মিত সকলে দৌড়াতাম এবং ব্যায়াম করতাম। আসার সময় বংগো বাজার থেকে গরম ট্র্যাক স্যুট এনেছিলাম। প্রথম দিন গুলজার ভাই বললেন উনি আমার সাথে দৌড়াবেন। উনি ক্যাডেট কলেজ স্প্রিন্টার ছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ড সফরের কথা ভেবে সবাই ওনাকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছিল। প্রথম দিন সকালে আমি উঠে দেখি গুলজার ভাই প্রস্তুত.শীতের সকাল বরফ পড়ছে। আমি স্বাভাবিক গতিতে দৌড়ে প্রায় ২ কিলোমিটার এগিয়ে দেখি গুলজার পাশে বা পিছনে নেই. দ্রুত
ফিরে এসে দেখি কয়েকটি কুকুর ডাকছে , গুলজার ভাই একটি গাছের উপর উঠে কাঁপছেন। আমি প্রতিবেশিদের অনুরোধ করে কুকুর গুলোকে সামাল দিয়ে নামালাম। সেদিনের পর থেকে গুলজার ভাই আর আমার স্তাহে যোগদান করেন নি. সোমবার থেকে শুক্র বার আমাদের সকাল ৯ থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত গ্যাস ইউনি গ্রনিগেন সদরদপ্তরে রীতিমতো ছাত্রদের মতো ক্লাস করতে হতো।দক্ষ অভিজ্ঞ পেশাদারদের কাছ থেকে সঞ্চালন পাইপলাইন ডিজাইন , উপকরণ সংগ্রহ , নির্মাণ কৌশল , পরিচালনা এবং রক্ষনাবেক্ষন বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা পেয়েছিলাম।
প্রশিক্ষণ এবং অন্যানো প্রসঙ্গ বিস্তারিত পরের পর্বে থাকবে।