সালেক সুফী।।
প্রিয় সবাই ,আমার এই প্রয়াস নিনান্ত ঘটনাগুলোর স্মৃতি রোমন্থন। কিছু সংখ্যা কিছু দিন তারিখ ভুল হতে পারে , কিছু মানুষের নাম অনিচ্ছাকৃত ভুল থাকতে পারে। আমি কিছু বিতর্কিত বিষয় ,কিছু মানুষের অনাকাঙ্খিত আচরণ সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেছি। যার যার আচরণ ব্যবহারের জন্য সে দায়ী থাকবে ,দায়ী থাকে। ইতিহাস খুব নিষ্ঠূর। কত মানুষ সেই ১৯৮১ সাল থেকে বিজিএসএল , কেজিডিসিএল , বিজিডিসিএল কাজ করে গাছে। কয়জন কেজিডিসিএলের সংকটের সময়ে এখজন দুর্বৃত্তকে নিয়ে কথা বলার সাহস দেখিয়েছে? কয়জন গ্যাস চুরি বিষয়ে শুরু থেকে সোচ্চার ছিল? সৌভাগ্য প্রবল প্রতাপশালী দুর্বৃত্তটি সরে যেতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার কারণে। পরিচয় দেয়া নিষ্প্রয়োজন। পাকিস্তানের স্বৈর সামরিক শাসকের নামে নাম মানুষটি আমাদের অনেকের শ্রম আর ঘামে গোড়া গ্যাস কোম্পানিটিকে দুর্নীতির অভয় অরণ্য বানিয়েছিলো।
আমি লিখেছিলাম আমাদের কয়েকজন সহকর্মী বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিবো। প্রথমেই বিজিএসএল নিয়ে লিখতে হলে সৌরমণ্ডলীর সূর্য চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিনকে নিয়ে লিখতে হয়। ওনাকে নিয়ে আলাদা ভাবে লিখেছি। উনি হলেন জ্বালানি সেক্টরের প্রবাদ পুরুষ ,একাই একটি প্রতিষ্ঠান। মহসিন ভাইয়ের পর লোধি ভাই , শামসুদ্দিন ভাই বিভিন্ন পর্যায়ে কোম্পানির অগ্রগতিতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তাদের প্রসঙ্গ পর্যায়ক্রমে আসবে।
শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন আহমেদকে অত্যন্ত সাদাসিধে সরল প্রাণ মানুষ নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্নে। উচ্চ শিক্ষিত মার্জিত এই মানুষটি কোম্পানির সূচনায় কয়েক বছর পর দুরারোগ্য ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
এরপর লিখছি কোম্পানির অন্যতম স্তম্ভ প্রয়াত খন্দকার মোমিনুল হক বিষয়ে। কোম্পানির সূচনায় উনার ব্যাপক মৌলিক অবদান আছে. সাদাসিধে মানুষটির সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিজিএসএল এবং জিটিসিএলে কাজ করেছি। কিছুটা আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ছিল। উচ্চ রক্ত চাপে ভুগতেন মাঝে মাঝে হতাশ হতে দেখেছি। কিন্তু তার অবদান ছিল বিশাল। তিনি এখন পরপারে।
চৌধুরী হাফিজুর রহমান ছিলেন কোম্পানির সূচনালগ্নে অর্থ বিভাগের প্রধান। স্বল্প ভাষী সদালাপী মানুষটি কোম্পানির সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অতন্ত্য দক্ষতা এবং সততার সঙ্গে পালন করেছেন। উনি এখন পরপারে।
কোম্পানির এক পর্যায়ে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার মুঈনুল আহসান কোম্পানিতে যোগদান করেন। গ্যাস সেক্টর বা গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ এবং সহকর্মীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়েছে। দীর্ঘ সময় একসাথে তার অধীনে কাজ করেছি। একজন দৃঢ়চেতা ,সফল ব্যাবস্থাপক। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন।
সেনাবাহিনীর দুইজন অবসর প্রাপ্ত মেজর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাদেক এবং রায়হানুল আবেদীন কোম্পানিতে অবদান রেখেছেন। সাদেক সাহেব মৃত্যু বোরন করেছেন। রায়হানুল আবেদীন বেঁচে আছেন। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ , জয়নাল আবেদীন দলদার , দিদারুল আলম পরবর্তীতে কোম্পানির অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন।
প্রকৌশুলি মাহবুবুর রহমান ছিলেন কোম্পানির প্রথম যুগের আরো একজন নীরব দক্ষ কর্মকর্তা। একসঙ্গে বিজিএসএল , জিটিসিএলে অনেক কঠিন কাজ করেছি। খুব কৌতুক মানুষ ছিলেন। পেট্রোবাংলার পরিচালক ছিলেন। মাহবুব ভাই মৃত্যু বরণ করেছেন।
প্রকৌশুলি মাহবুব ছিলেন একজন দক্ষ পুরোকৌশুলী। কোম্পানির পুরকৌশল কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
কোম্পানির সূচনায় অলকেশ দাদা, তাওফিক ভাই, কামরুল ভাই, ফারুক ভাই , হাই ভাই , ইকবাল, ওয়াহাব , হামিদি, এনায়েত ,হাকিম সর্দার , আহসান হাবিব, নেয়াজুর রহমান, এদের অনেক অবদান ছিল।
অধস্তন অনুজদের নিয়ে পরে লিখবো। বিশেষত নাজমুল, আমজাদ, সানোয়ার , জামিল, মুস্তাফিজ , ফিরোজদের নিয়ে লিখবো।
বিজিএসল সঞ্চালন বিভাগের গোড়ার কথা
বাখরাবাদ -চট্টগ্রাম পাইপলাইন কম্মিশনিং হবার পরদিন সকলে ফৌজদারহাট সিজিএসএ এসে কোম্পানি প্রধান আমাদের সবাইকে অভিনন্দিত করেন। বিজিএসএল বিশেষত চট্টগ্রামে গ্যাস আনা ওনার লালিত স্বপ্ন ছিল. দৃঢ় চেষ্টা মানুষটির চোখে মুখে প্রশান্তির ছাপ দেখলাম। নিজে থেকেই আমাদের ১০ দিনের বিশ্রাম দেয়া হলো. আমরা পাইপ লাইন নির্মাণ টীম অধিকাংশ সিলেট ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমি সোহো কয়েকজন স্ত্রী সফর সঙ্গী হয়েছিল। কয়েকদিনের সিলেট সফরে আমরা দুটি মাজার জেয়ারত ছাড়াও জাফলং ,তামাবিল এবং আমার দুই বন্ধু হেলাল এবং জিয়া ভাইর কর্মস্থল চা বাগান পরিদর্শন করেছিলাম। মনে আছে জিয়া ভাইর ভারত সীমান্ত সংলগ্ন চাতলাপুর চা বাগান থেকে ফেরার সময় রাতের আঁধারে ভুলে আমরা ভারতে ঢুকে পড়েছিলাম. বিএসএফ আমাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করে সঠিক পথ নির্দেশ দিয়েছিলো। আমরা হেলারের বাগানে রাত্রিযাপন করেছিলাম।
সিলেট থেকে ফিরে অফিস আদেশ পেলাম আমাকে প্রধান করে বিজিএসল সঞ্চালন ডিপার্টমেন্ট সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন স্যারের তত্ত্বাবধানে কোম্পানির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদার হাট সিটি গেট স্টেশন চালু সহ স্থাপনাটির অবয়ব সৃষ্টি, পাইপ লাইনের ক্যাথোডিসি নিরোধ ব্যবস্থা, টেস্টিং কমিশনিং কাজ, রিং মেইনে HP DRS , সঞ্চালন পাইপলাইন TBS নির্মাণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আমার সঙ্গে আজিজুল হক, এনামুল করিম সওদাগর , সানোয়ার হোসেন চৌধুরী , জামিল আহমেদ আলিম ছিল. শাহাদাৎ ভাইকে বিতরণ সিস্টেম ডিজাইন পরামর্শক PCR সঙ্গে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। দৈনিক ১৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন সিটি গেট স্টেশনটি ANSI #400 সঞ্চালন পাইপলাইনে প্রবাহিত সর্বোচ্চ ৯৬০ পিএসআই চাপের গ্যাস লিকুইড এবং ময়লা অপসারণ করে ৩৫০ পিএসআই চাপে চট্টগ্রাম রিং মেইনে সরবরাহ করার ডিজাইন করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের KING Tool কোম্পানি CGS সরবরাহকারী এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ কাজের ৯০% শাহাদাত ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। বাদ বাকি কাজ দ্রুত আমাদের টিমের তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত হয়। আমাদের সবাইকে কয়েকজন অপারেটর সহ হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল। আমরা CGS সহ সঞ্চালন পাইপ লাইনের AJ Built Documents archive সৃষ্টির কাজ শুরু করেছিলাম। তখন আমরা cgs এবং পাইপ লাইনের অপারেশন গাইডলাইনস সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করেছিলাম।
পাশাপাশি সিজিএস প্রাঙ্গনের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ করে পরিচ্ছন্ন ফুলের বাগান সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিলাম
অবশেষে আসলো মাহেন্দ্র ক্ষণ CGS টেস্টিং এবং পরিক্ষামুলক ভাবে চালু করা হবে।মহসিন ভাইকে দিনক্ষণ জানালাম। উনি চট্টগ্রাম আসলেন। কিন্তু বিশেষ সভায় ব্যাস্ত থাকায় আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে উপদেশ দিলাম। মনে আছে দুপর ২ নাগাদ স্টেশনটি পরিক্ষামুলক চালু হবার জন্য প্রস্তুত। আবারো মহসিন ভাইকে অনুরোধ করলাম। উনি বিসমিল্লাহ বলে চালু করার নির্দেশ দিলেন। আজিজ ,সানোয়ার , জামিল সবার উপস্থিতিতে চট্টগ্রামে আমি সালেক সুফীর হাতের ছোয়ায় চট্টগ্রামে জ্বলে উঠলো প্রাকৃতিক গ্যাসের দীপ শিখা। স্টেশনের স্মৃতি ফলকে অবশ্যই নাম লেখা আছে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের নাম। সেটাই থাকার কথা. কিন্তু চট্টলার মাটিতে প্রথম গ্যাস শিখা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সানোয়ার ,জামিল , আজিজ ,আমি এবং আর কয়েকজনের। মুহূর্তের জন্য উত্তেজনা বশে ৬০ এমএমসিএফডি পুরোটাই ফ্লোরিং করেছিলাম। আলোয় আলোকিত বিশাল অঞ্চল। হয়তো সেটা দেখেই ছুতে এসেছিলেন মহসিন ভাই. আন্তরিক আলিঙ্গনে আমাদের জড়িয়ে ধরেছিলেন। ইতিহাসের সাক্ষ হয়ে রইলাম আমরা কয়েকজন।
ওই সময় জাহাঙ্গীর ভাই, নুরুস সাফা ভাই , জয়নাল অবদান ভাই সহ কয়েকজন আমাদের উচ্চ পদে যোগদান করলেন। সাফা ভাইকে আমাদের উপব্যবস্থাপক বানানো হয়েছিল। উনি আমার BUET সিনিয়র এবং তিতাস গ্যাস সহকর্মী ছিলেন ১৯৮০ সালে চাকুরী নিয়ে ইরাক চলে গিয়েছিলেন। আমাদের একসঙ্গে কাজ করায় অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং শিশু সন্তানকে কাছে থেকে দেখাশুনা করাও জরুরি ছিল। তাই অনুরোধ করেই বদলী হয়ে কুমিল্লাআঞ্চলিক বিতরণ কার্যালয়ে যোগদান করলাম। অবশ্যই আসার আগে চট্টগ্রাম রিং মেইন গ্যাস কমিশনিং কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম।
চলবে।