সালেক সুফী।।
১৯৯৪-২০০৫ বাংলাদেশ এনার্জি সেক্টরে আমার কর্মজীবনের ছিল অন্যতম সেরা সময়. আমরা যেমন ভোরের পাখি হয়ে দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিজিএসএল কোম্পানি গড়ে তুলেছিলাম তেমনি ১৯৯৪ থেকে সুযোগ আসলো পেট্রোবাংলা কোম্পানি সমূহের পুনঃবিন্যাশ প্রক্রিয়ায় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির সূচনা লগ্নে কাজ করার। বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি থেকে আমাকে পেট্রোবাংলা আদেশে বদলি করে নতুনভাবে উপমহাবাবস্থাপক ( পাইপলাইন ) হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ১৯৯০-৯৪ বিজিএসেলে দ্বিতীয় পর্বে পরিকল্পনা বিভাগ থেকে কোম্পানির কর্পোরেট প্ল্যানিং , মেটেরিয়াল প্ল্যানিং ,রিজিওনাল প্ল্যানিং অনেক শৃঙ্খলার মধ্যে আনছিলাম। গ্যাস চুরির বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নিয়েছিলাম। সর্বোপরি কুমিল্লার চাঁপাপুরে কোম্পানির আবাসিক এলাকায় ক্রীড়া সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিলাম।
গ্যাস সেক্টরের প্রাক্তন সবার মনে আছে সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে কৈলাশটিলা পর্যন্ত পরিকল্পিত উত্তর- দক্ষিণ পাইপ লাইন নির্মাণ কাজে ইতালির প্রখ্যাত সাইপেম কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে সেই বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে আরবিট্রেশন পর্যায়ে গিয়েছিলো। সিলেট অঞ্চলে স্থানীয়দের বাধার মুখে বিয়ানীবাজার কৈলাশটিলা অংশের পাইপলাইন অসম্পূর্ণ রেখেই সাইপেম চলে যায়।
এই সময় পর্যন্ত গ্যাস গ্রিড যমুনার পূর্ব পাড়েও সমন্বিত ছিল না।সিলেট অঞ্চলে পর্যাপ্ত গ্যাস থাকলেও আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ লিংক লাইনের অবর্তমানে উৎবৃত্ত গ্যাস জাতীয় গ্রিড দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সঞ্চালন করার সুযোগ ছিল না।
প্রাথমিক ভাবে ন্যাশনাল গ্যাস ট্রান্সমিশন গ্রিড নামে পেট্রোবাংলার অধীনে পৃথক গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন গঠনের পরিকল্পনা থাকলেও অন্নান্য প্রভাবশালী কোম্পানি তথা জ্বালানি সেক্টরের রক্ষণশীল পলিসি মেকার্সদের সিদ্ধান্তের কারণে জিটিসিএল নামে নতুন কোম্পানি গড়ে উঠে. প্রাথমিকভাবে কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয় উত্তর-দক্ষিণ পাইপলাইন পরিচালনা এবং আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ। অবশ্য কোম্পানির বিজনেস পলিসি অনুযায়ী ১০০০ পিএসআই বা তার বেশি চাপে পরিচালিত সকল পাইপ লাইন এবং স্থাপনা যেগুলো জাতীয় গ্যাস গ্রিডের অংশ সেগুলো জিটিসিএলের অধীন আসার কথা আছে।
যাহোক বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশন মডেল অনুসরণ করে আশুগঞ্জ থেকে বাখরাবাদ পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩০ ইঞ্চি পাইপলাইন ব্রহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা অঞ্চলের প্লাৱন ভূমিতে নির্মাণ ৯০ দশকের মাঝামাঝি অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। ত্তর -দক্ষিণ পাইপ লাইনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার প্রথমেই পাইপ লাইনের পথসত্ব বিষয়ে সতর্ক ছিল। পেট্রোবাংলার উর্ধতন কর্মকর্তারা পাইপ নির্মাণে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা বিষয়ে অবহিত ছিলেন। তাই একটি বিশেষ মহল আমার জিটিসিএল যোগদানে বাধা সৃষ্টি করলেও উর্ধতন মহলের দৃঢ়তার কারণে সুবিধা করতে পারে নি। আমি শুরুতেই কুমিল্লা থেকে পরিবার ঢাকায় স্থানান্তর করি। জিটিসিএল মূলত পূর্বতন পিআইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকার উত্তরায় কার্যালয় স্থাপন করে। আমি আমার স্ত্রী আর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে উত্তরায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলি। উত্তরায় ৩ নম্বর সেক্টরে আমার একটি আবাসস্থল এখনো আছে।
প্রথমেই চ্যালেঞ্জ দেখাদিল টিকাদার নির্বাচনে। অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল পাইপলাইন নির্মাণ কাজে কমপক্ষে ৫১% মূল্যমানের উপকরণ এবং যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ৭ ১/২ % বিড প্রেফারেন্স পাবে। ১৯৯০ দশকে বাংলাদেশে ৩০ ইঞ্চি পাইপলাইন নির্মাণে ব্যাবহৃত নির্মাণ যন্ত্রপাতি ছিল না। তা ছাড়া লাইন পাইপ এবং নির্মাণ যন্ত্রপাতি প্রকল্প খরচের ৪০% ছিল।তথাপি স্থানীয় ঠিকাদারদের একটি কনসোর্টিয়াইমকে কোরিয়ান কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দরপত্রে দ্বিতীয় নিম্নতম দরদাতাকে প্রকল্প নিয়োগ দেয়ার জন্য মোটামুটি জাতীয় পর্যায়ে অনেকটা ঐক্যমত হয়েছিল। আমি এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংক গাইড লাইন পরে জেনেছিলাম বিদ্যমান অবস্থায় বিশ্বব্যাংক এই ভাবে প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হওয়ার প্রশ্নই ছিল না. আমি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য না হলেও আমাকে সম্পৃক্ত রাখা হয়েছিল। আমি দেখলাম এই বিষয়ে কমিটি দেশীয় কোম্পানিকে কাজটি অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যে দিয়ে দিতে ঐক্য মত। স্থানীয় ঠিকাদার কনসোর্টিয়াম আওয়ামী লীগ , বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কোম্পানি ছিল।সংবাদপত্রগুলো সজাগ ছিল। আমি দরপত্র কমিটির অনুমতি নিতে প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণও কাজ পথ স্বত্ব অধিগ্রহণ কাজ নির্বিঘ্ন করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক অফিসে অধিকাংশ সময় থাকি। ওই সময় মরহুম সৈয়দ আনোয়ারুল হক জিটিসিএল ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবং মরহুম আজিজুল হক প্রকল্প ব্যাবস্থাপক ছিলেন। আমাকে প্রধান করে মাহমুদ খান , মুহিতউদ্দিন , মফিজউদ্দিন , শ্যামল রায় , দুইজন তরুণ প্রকৌশুলি এবং প্রয়াত প্রকৌশুলি হারুন (একজন বিশ্বব্যাংক পরামর্শক) সমন্বয়ে একটি কমিটিকে পাইপলাইন পথসত্বে ক্ষতিগ্রস্থ প্রকৃত মালিকদের সরাসরি জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এককালীন ১০% অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দেয়া হয়। মনে আছে ঝড় বৃষ্টি , প্লাবন উপেক্ষা করে আমরা ৩৫ দিন অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রকৃত মালিকদের হাতে প্রায় ৪ কোটি টাকার একাউন্ট পেই চেক পৌঁছে দিয়েছিলাম। কাজটি ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। কাজের শুভ প্রভাব পড়েছিল। স্থানীয় অঞ্চলের গন্যমান্য ব্যাক্তি সাধারণ মানুষদের সঙ্গে একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
ওদিকে বাংলাদেশ পাইপ লাইন কনসোর্টিয়াম -হুন্দাই জেভিকে পাইপ লাইন নির্মাণ চুক্তি প্রদান বিশ্বব্যাংক মিস প্রকিওরমেন্ট বিবেচনা করে অনুমোদন না করায় এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেয়ায় পেট্রোবাংলা বাধ্য হয় প্রকৃত সর্বনিম্ন দরদাতা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককোনেল ডাওয়েল কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়ায়। সেখানেও বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছিলো। এই সব কাজে অনেক সময় নস্ট হওয়ায় বর্ষা এসে পড়ছিলো। ওদিকে রাজপথে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদন বিভ্রাট ঘটায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিলো। এই সময় আজিজুল হক সাহেবকে কিছু দিনের জন্য পেট্রোবাংলায় ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে প্রকল্প ব্যবস্থাপকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।অধিকাংশ সময় কাটে আইনি পরামর্শক কামাল হোসেন এসোসিয়েটসের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিকাদারের সঙ্গে পত্র যুদ্ধে। এই সময় সুযোগ হয়েছিল ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার। উনি আমাকে খুব উৎসাহিত করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে ঠিকাদার কিছু কাজ শুরু করে প্রকল্প বর্ষা মৌসুমের আগে শেষ না করার টালবাহানা করতে থাকে। চুক্তি অনুযায়ী আমি ইঞ্জিনিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে ঠিকাদারের বিচ্যুতি উল্লেখ পূর্বক নিয়মিত পত্র লিখি। একসময় ঠিকাদার প্রতাব দেয় তাদের বাংলাদেশের পরিবর্তে বিদেশে লাইন পাইপ কোটিং এবং কংক্রিট কোটিং করতে দেয়া হলে তারা চুক্তি মূল্যে সম্মত বর্ধিত সময়ে প্রকল্প সম্পাদন করবে। নানাধরণের আইনি বিশ্লেষণের পর বিশ্বব্যাংকের সম্মতি সাপেক্ষে আমেন্ডেড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলার এমদাদুল হক কিছুদিন থাকার পর বাখরাবাদ থেকে মুঈনুল আহসান জিটিসিএলে ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হয়ে আসেন। ফিরে আসেন আজিজুল হক।জিটিসিএলে আইনুল কবির, আসাদ , মাহতাব সহ একঝাঁক নতুন প্রকৌশুলি যোগদান করে
১৯৯৬ নির্বাচনে আওয়ামী নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে।তখন দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস বিদ্যুৎ সংকট। আশুগঞ্জ বাখরাবাদ পাইপ লাইন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পরিণত হয়।সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিদিন প্রকল্পের অগ্রগতি মনিটরিং শুরু হয়।আমাদের কাছেও প্রকল্পটি আরো একটি যুদ্ধে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত সেনা প্রধান জেনারেল নুরুদ্দিন খানকে জ্বালানি মন্ত্রী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে প্রতিমন্ত্রী এবং ডক্টর তাওফিক এলাহী চোধুরীকে জ্বালানী সচিব নিয়োগ দেন।
পাইপ লাইন নির্মাণ চ্যালেঞ্জ থাকবে পরবর্তী পর্বে।