সালেক সুফী।।
সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণের শেষ পর্ব বর্ণনার পূর্বে বন্ধু সহকর্মীদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু লিখছি। প্রকল্পটির শুরু থেকেই ঢাকা অফিসে কর্মরত ছিলেন আমার দুই বুয়েট কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ার অগ্রজ শাহাদাত আলী ভাই এবং মোস্তাক আহমেদ সিদ্দিকী। পরে আমাদের সাথে যোগদানকারী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ওনাদের শুরুতে কাজ ছিল প্রকল্প পরামর্শকের সঙ্গে পাইপলাইন নির্মাণের দরপত্র , মালামাল উপকরণ ক্রয়ের দরপত্র প্রণয়ন ,দরপত্র মূল্যায়ন কাজ। অলকেশ চৌধুরী , কামরুল ইসলাম ওদের সংগী ছিল। মোস্তাক ভাই পাইপলাইন নির্মাণ কাজ শুরু হলে পেট্রোবাংলায় ফিরে যায়।অনেক দিন দেখা হয় না। শুনেছি উনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে উঁচু পদে কর্মরত আছেন। শাহাদাৎ ভাই আগেই বলেছি চট্টগ্রাম সিটি গেট স্টেশন এবং উত্তর পতেঙ্গায় HDD পদ্ধতিতে কর্ণফুলী নদী ক্রসিং তদারকি কাজে নিয়োজিত ছিলেন। মাঝে মধ্যে আমাদের কাজ দেখতে আসতেন। শাহাদাৎ ভাই বিজিএসেলে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ১৯৯৬-২০০১ বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী টার্মে মেঘনা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে বাখরাবাদ এবং সালদা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে বাখরাবাদ দুটি সঞ্চালন পাইপ লাইন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যাবস্থাপক ছিলেন। এখন কানাডার নাগরিক। থাকেন টরন্টো। আমরা এখসময় বিদেশে অবস্থাকারী পেট্রোবাংলা কর্মকর্তাদের একটি ফেস বুক গ্রূপ করেছিলাম পেট্রোদেশ নামে। আজো ওনার সাথে হোয়াটস আপ কথা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ শুরুতে আমাদের সঙ্গে ছিল। একসময় স্থানীয় ঠিকাদারের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কালুরঘাট কর্ণফুলী ক্রসিং কাজ তদারকি করে। সবাইকে বিস্মিত করে চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে এনার্জি সেক্টরে ব্যাবসা শুরু করে। মিন্টু আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। এখনো যোগাযোগ আছে। নিউজিলণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন থেকে এখন বাংলাদেশে। আমার সবসময়ের সারথি শহিদুল আবেদীন আমার অনেক ঘনিষ্ট। একই প্রকল্পে আবেদীন ফ্রন্ট লাইন কাজ তদারকি দলের প্রধান ছিল। সীতাকুন্ড ক্যাম্পে পাশাপাশি ছিলাম। পরবর্তীতে আবেদীন কুমিল্লা ল্যাটারাল আর আমি চাঁদপুর লাটারল কাজ একই সময় তদারকি করি।প্রশিক্ষণে একই সঙ্গে ইংল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ড ছিলাম। পেট্রোবাংলার পরিচালক হয়ে আবেদীন অবসর গ্রহণ করে। এখন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত আছে। গুলজার ভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন ওয়েল্ডিং, ওয়েলডিং ইন্সপেকশন তদারকির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। ওনার কথা মনে হলেই ওয়েল্ডিং রেকর্ডস টয়লেট পেপার রোলে সংরক্ষণের কথা মনে হয়। আমাদের সাথে ইংল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ড প্রশিক্ষণে ছিলেন। পরবর্তীতে পরিবার সহ কানাডা চলে যান।আমার সাথে কালগারি দেখা হয়েছিল। উনি আর বেঁচে নেই।একই ভাবে আমার ওপর সহপাঠী এবং সহকর্মী আজিজ কানাডা প্রবাসী হয়েছিল। আজিজ বেঁচে নেই। অনুজ সহকর্মীদের নিয়ে পরের পর্বে লিখবো।
পাইপলাইন প্রক্লপের ধারাবাহিকতা
গুণবতী অঞ্চলে দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজের আগেই আমার দলের তত্ত্বাবধানে গুণবতী -লাকসাম সেক্শনে কিছু টাই ইন ,লাকসাম রেল এবং সড়ক ক্রসিং তিনটি ভালভ স্টেশন , ডাকাতিয়া নদী দ্বিতীয় ক্রসিং , বিজরায় চাঁদপুর রড ক্রসিং ,বিজরা থেকে কুটুম্ববপুর বেশ কিছু টাই ইন কাজ সম্পন্ন হয়।আবেদিনের CREW কুটুম্বপুর থেকে বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র পর্যন্ত সব কাজ শেষ করে। শুধু বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের অভ্যন্তরে মেইন লাইন ভালভ -১ এবং পিগ লঞ্চার আমার দলের তদারকিতে সম্পাদিত হয়।
পাইপলাইন কমিশনিং কাজ
আগেই বলেছি ১৯৮2 ডিসেম্বর মাস সানোয়ার ,শফিককে নিয়ে গুণবতীতে অবশিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য তাবু গাড়ি। হয়তো ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এই রেল পথের ধরে পসিশন নিয়ে যুদ্ধ করেছিল মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা। আগেই লিখেছি গুণবতী রেল ক্রসিং সহ তিনটি ভাল্ভ স্টেশন নির্মাণ কাজ জন বাকলে CREW অবিস্বাশ্য দ্রুততায় ১৩ ডিসেম্বর শেষ করে। বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ডাকাতিয়া নদীর পুব পাড়ের অংশ পর্যন্ত হাইড্র র্টেস্ট শেষ হয় ১৪ ডিসেম্বর মাঝ রাতে । বাকি থাকে ফাইনাল টাই ইন। কৌশলগত কারণে আমরা কাছের ভালভ বন্ধ রেখে পাইপলাইন পানি রেখে দেয়। ১৪ ডিসেম্বর মদ্ধরাত প্রচন্ড শীত অপেক্ষা করে দুইজন সেরা ইতালিয়ান ওয়েল্ডার পাইপ লাইনের শেষ ওয়েল্ডিং করে। ওরা দুইজন প্রবীণ আমাকে ছেলের মতো দেখতো। প্রোপানে টর্চ দিয়ে পাইপ প্রান্ত উষ্ণ করার পর ক্যাম্পিং করে ৰূট পাস পর্যন্ত আমি ওয়েল্ডারদের পাশে ছিলাম। ৰূট ৯০% শেষ করার পর আমাকে দেখায়। আগেই প্রতিশ্রুতি দেয় ওরা অনেক সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করবে। পুরো ওয়েল্ডিং শেষ করতে সকাল ১:৩০ হয়ে গেলো। ঠিকাদার প্রতিনিধি রেডিওগ্রাফি করে রাতেই চলে যায়. অনুরোধ করি খুব সকালে ইন্সপেকশন রিপোর্ট আমাকে জানায়। বাকি রাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি। আমরা হয়তো মহান বিজয় দিবসে গ্যাস চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পারবো। সকালে বাধলো বিভ্রাট। রেডিওগ্রাফ প্রস্তুত সীতাকুণ্ডে ইন্সপেক্টর চলে গাছে কুমিল্লা। গ্যাস ক্ষেত্রে মহসিন ভাই, সালমান ভাই সহ সবাই তিন টিনটি পিগ লোডিং করে অপেক্ষায়। কর্নেল এনাম রেডিও যোগাযোগ করল। পরিস্থিতি জেনে আমি রেডিও জপগজপগ প্রিয় মোহসিন ভাইকে শুনিয়ে বলেছিলাম ” Radiographed or not please be advised that me Saleque Sufi saw the root going in. Was standing right beside the weld. I guarantee a flawless weld . I put my head under the sword. If my boss has confidence in me please kick the commissioning pig right now. ” সানোয়ার এবং হয়তো ৪০ টি সচল রেডিও আমার কথা শুনেছে। আমার বিষয়ে মহসিন ভাইয়ের পরম আস্থা ছিল। তাই ঠিক সকাল ৯:০০ টায় কমিশনিং পিগ লঞ্চ হয়। সব ভালভ স্টেশনে আমাদের প্রকৌশলী বৃন্দ অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। আমরা আমাদের প্রান্তে পিপেলিনের বলো ডাউন খুলে রাখি। দুপুর ১ টা নাগাদ কুটুম্বপুর ,তিনটা নাগাদ বিজরা , ৫ টা নাগাদ লাকসাম অতিক্রম করে পিগ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আটটা নাগাদ গুনবতী ভালভ স্টেশন বলো ডাউন দিয়ে পানি বের হতে শুরু করে। পৌষ মাস পূর্ণিমা রাত। ভাল্বের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মহসিন ভাই আসলেন সালমান ভাই, আসলাম শের খান আর কর্নেল এনামকে নিয়ে। চাঁদের আলো পরে ঝর্ণাধারার মতো পানিকে মনোরম লাগছিলো। ওনারা অনেক ছবি তোলেন। আমি কারো সাথে কিছু কথা বলিনি। শুধু আসলাম সাহেব হেবকে অনুরোধ করি রাতে পিগ গুলো ফেনী পৌঁছানোর পর আমরা দ্রুত ফেনী থেকে কারো অপেক্ষা না করেই পিগ ছেড়ে দিবো। বলা বাহুল্য পিগ ফেনী পৌঁছাতে সকাল হয়ে গেলো। সেখানে বাকলে আগে থেকেই crew রেখেছিলো। পিগ লঞ্চ করে আমরা আগের পিগগুলো একটু একটু করে বের করি. পলি পিগ ছিড়ে গেলেও বাকি দুটি পিগ অক্ষত ছিল। পাইপ লাইন থেকে কয়েকটি সোল মাছ , কিছু গুঁড়া চিংড়ি মাছ বের হয়েছিল।
দ্বিতীয় পর্বের পিগ সিজিএস পৌঁছাতে ১৬ ডিসেম্বর মদ্ধরাত পার হয়ে যায়। আমার দল ফেনী নদীর শুভপুর ভালভ স্টেসন পার করে সলিমপুর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সামনের ভাল্ভ ১৪ মনিটরিং করতে থাকি। এখানে কি ঘটেছিলো সেই বর্ণনাটুকু সানোয়ার যদি এটি পরে দিলে ভালো হবে. আমি ,সানোয়ার একই কাপড় পরে ১৪ দিন কাটিয়েছি। চেহারা ভুতের মতো হয়ে গিয়েছিলো। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮৩ ভোর রাত দুইটায় গ্যাস পৌছালো সিটি গেট স্টেশনে। সাক্ষী আমার সাথে সানোয়ার , সোফিক ,শাহাদাৎ ভাই এবং বন্ধু মেজর আহসানুল্লাহ। আরো একটি যুদ্ধ জয় উৎসর্গ করলাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বন্ধুদের। মোহসিন ভাই চট্টগ্রামে রাত জেগে আমাদের কথোপকথোন রেডিওতে শুনছিলাম। সিটি গেট আসতে অনুরোধ করলাম। উনি আমাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে রাতে বাকি সময় বিশ্রাম নিয়ে সকালে আসতে অনুরোধ করলাম। ডিসেম্বরের শীতেও ঘাম ময়লা , পাইপ লিনের রং লেগে ভুতের চেহারা। সানোয়ার অর্ধ উলঙ্গ। সে রাতের স্মৃতি এখনো আমাকে আপ্লুত করে।
এই অনুভুতি একান্তই আমার আমাদের। দেশ থেকে মিথ্যা অজুহাতে পরবাসে পাঠালেও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।মনে আছে আমরা জয় ব্যাগলা ধোনি দিয়েছিলাম।