সালেক সুফী।।
বন্ধুদের অনুরোধে শিরনাম পাল্টে দিলাম। আমি মানুষটাই এমন কোথাও কোনো কাজের দায়িত্ব পেলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাই না। মানুষদের সাথে মেশা ,গভীর ভাবে জানা আমার স্বভাবজাত। মা বাবা ,শিশু কালের পরিবেশ এমনটাই শিখিয়েছে আমাকে। আগেই বলেছি ১৯৭১ র মুক্তিযুদ্ধ আমার বিবেক সম্পূর্ণ আলোড়ন করে দিয়েছিলো। বাংলাদেশের গ্রাম প্রান্তরে অসহায় মানুষের আর্তনাদ ,পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পৈচাশিক গণহত্যা ,ধর্ষণ প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশে যতটুকু পেরেছি সকল ক্ষেত্রে মুক্তি যুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় থেকেছি। সুযোগ হয়েছে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের। লিখেছি অহংকারের একাত্তর শিরোনামে। আমার জন্য গ্যাস সেক্টরের প্রতিটি বড় প্রকল্প ছিল এক একটি মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি প্রকল্প শেষে গ্যাস চালু হলে মনে হতো যুদ্ধ জয় করেছি।
বিজিএসএল ধারাবাহিক
ফেনীতে আমাদের থাকার জায়গা হয়েছিল ডাক্তার পাড়ার ভাড়া বাড়িতে। আবেদীন সহ একটা গ্রুপ কুমিল্লা অঞ্চলে এগিয়ে গিয়েছিলো। সবাই জানে ফেনী ,চোদ্দগ্রাম অঞ্চলে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে অনেক মুখোমুখি যুদ্ধ হয়েছে। তাই কাজের সময় বিশেষত বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসানউল্লাহ ভাই এবং দোস্ত ভাইকে সঙ্গী পেয়ে নিজের মধ্যে একাত্তর জেগে উঠে। আমরা এখানে নদী ক্রসিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতাম। কয়েকবার আমাকে সিভিল ড্রেসে গোয়েন্দারা জেরা করলেও দমাতে পারে নি।এই সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা ডাচ পাইপলাইন কোম্পানীর নাক্যাপ সুখ্যাত পাইপলাইনার জন বাকলি স্প্রেড বস হিসাবে যোগদান করে। আগেই বলেছি ফেনী নদী থেকে চোদ্দগ্রামের গুণবতী পর্যন্ত এলাকা বিশেষত ডাকাতিয়া নদী এবং রেল লিনের উভয় পাশ ছিল নিচু এলাকা। বছরের অধিকাংশ সময় জল মগ্ন থাকতো। ওই এলাকায় তিনটি মেইন লাইন ভাল্ভ স্টেশন নির্মাণ করতে হয়েছিল। কাজটি ছিল দুরূহ। মে জুন মাস নাগাদ বর্ষা আসছিলো। ২৪ ইঞ্চি পাইপলাইন। ভালভগুলো ডিজাইন অনুযায়ী মাটির নিচে বিশেষ ভাবে নির্মিত সেলারে থাকবে। আমি অন্তত তিনটি ভাল্ভ মাটির উপর স্থাপনের সুপারিশ করেছিলাম। পরামর্শক প্রতিনিধি সায় দিয়েছিলো। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় বেন্ড ,ফিটটিংস ক্রয় সময় সাপেক্ষ বিধায় মহসিন ভাই সম্মত হন নি। বাংলাদেশ গ্যাস এক্ট অনুযায়ী রেল এবং যদি ক্রসিংয়ের দুই পারে ভাল্ভ থাকার বিধান ছিল।আসন্ন বর্ষার কারণে তিনটি ভালভ স্টেশন ফেনী পরিত্যাক্ত বিমান বন্দরে ফ্যাব্রিকেশন করা হয়।কিন্তু সমস্যা হয় আগাম বর্ষায় ফেনী আইসিএস থেকে গুণবতী পর্যন্ত অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়ায়। আমরা বেপরোয়া মানুষ। বাকলে , এনাম ভাই , এহ্সানুল্লাহ ভাই আলাপ করলাম কোনো ভাবে ফ্লাট বডি রেল ওয়াগন দিয়ে হাসনাবাদ এবং গুণবতী স্টেশনের মাঝ এলাকায় ভালভ গুলো নেয়া সভভ কিনা। কাজটি দুঃসাহসিক। কিন্তু কিছু অর্জনের জন্য ঝুঁকি কখনো মৃত্যু ঝুঁকি নিতে হয়. আমাদের কাজটি ছিল রেল ওয়াগন ম্যানেজ করা , ঢাকা চট্টগ্রাম ব্যাস্ত রেল লাইন সঠিক সময় নির্ধারণ ,এবং রেল লাইনের ঢালুতে ক্রেন এবং সরঞ্জাম নিয়ে বাকলে বাহিনী প্রস্তুত থাকা। কিভাবে অপারেশন গুণবতী ম্যানেজ হয়েছে বিস্তারিত বিবরণে যাবো না।সঠিক দিনে সঠিক সময়ে নিখুঁত ভাবে অপারেশন সফল হয়। মাত্র ২০ মিনিট বাক্যে বাহিনী তিন তিনটি ভালভ যথাস্থানে নামিয়ে ফেলে। ফ্লাটবডি নিয়ে ইঞ্জিন হাসনাবাদ স্টেশন পৌঁছানোর ১০ মিনিটের মধ্যে মেইল ট্রেন এই পথে পার হয়ে যায়। এই রেলপথে পাক বাহিনীর সঙ্গে মিত্র বাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। এখানে কাজ করার সময় সেই অনুভূতি কাজ করেছে।
ফেনী নদী ক্রসিং ছিল রোমাঞ্চকর. তখন কিন্তু এখনকার মতো এইচডিডির প্রসার ঘটেনি। তাই ফেনী ,মুহুরী ,কালিদাস পাহাড়িয়া নদী আমরা ওপেন কাট সারফেস পুল পদ্ধতিতে অতিক্রম করি। নদীর উঁচু পাড়ে কংক্রিট কোটেড লাইন পাইপ ওয়েল্ডিং করে রেডিওগ্রাফির পর পরিহাইড্রোটেসট করা হয়. এর পর এন্ড কাপ লাগিয়ে পাইপলাইন এলাইনমেন্ট বরাবর ফ্লোটিং ট্রেঞ্চে বসানো হয় ফ্লোটিং ড্রাম বেঁধে। অপর পাড়ে আমাদের ২৬০ কিলোগ্রাম ওজনের মার্কিন বন্ধু বেন রোবার্টসন নিজের বানানো উইঞ্চ নিয়ে পাইপলাইন অংশ টেনে নেয়ার অপেক্ষায় থাকে। ড্রেজার পাইপ এলাইনমেন্ট ২৫ ফুট ড্রেজ করে স্ট্যান্ডবাই দাঁড়িয়ে।
মহসিন ভাই আসলেন ঘড়ির কাটায় সঠিক সময়ে । আমি ওনাকে নেতৃত্ব দেয়ার আহবান জানালে আমাকে লিড নিতে বলেন। কয়েক হাজার মানুষ নদীর দুই প্রান্তে অধীর আগ্রহে শুভপুর এলাকায়। যেন যদি পাড় হলেই যুদ্ধ জয় হবে। জোয়ারের অপেক্ষা। সারি সারি সাইড বুম পাইপ উঁচু করে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ আমার। একহাতে ওয়াকি টোকি অন্যহাতে হ্যান্ড মাইক। মাহেন্দ্র খন উপস্থিত। মহসিন ভাইয়ের ইশারায় আল্লাহকে দয়া করতে সূচনা করলাম আস্তে আস্তে ফেনী থেকে পাইপ চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছে। ৫০% যাওয়ার পর বেন জানালো উইঞ্চ চলছে না। আমি ইশারায় মহসিন ভাইকে জানিয়ে এপার থেকে এগিয়ে গেলাম। এই অবস্থায় অনেকেই মুষড়ে পড়তো। কিন্তু যুদ্ধজয়ী নেতার মতোই অবিচল নেতা মহসিন ভাই। আল্লাহ সহায় উইঞ্চ চালু হলো। ১০ মিনিট শেষ হলো ফেনী নদী ক্রসিং। বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমাণ্ডর সুলতান ভাই ডুবুরি দল নিয়ে পরিক্ষা করলেন লাইন পাইপ সঠিক পরীখায় পড়লো কিনা। সেদিন অনেক অভিনন্দন পেয়েছিলাম। আমার বস মহসিন ভাই নিজের মাথার তুপি খুলে আমার মাথায় দিয়েছিলেন। একই পদ্ধতিতে মুহুরী এবং কালিদাস পাহাড়িয়া যদি ক্রসিং হয়। সেগুলো পরের পর্বে লিখবো। আমার সঙ্গে নাজমুল, মুস্তাফিজ ,জামাল , কয়েক জন সহকর্মী , কর্নেল এনাম , এহসান ভাই , দোস্ত মোহাম্মদ ছিলেন। আরো ছিল কর্মী বাহিনী। এখনো ফেনী বাইপাসে সড়ক পথে গেলে সেই দিনের স্মৃতি শিহরণ জাগায়।
চলবে।