সালেক সুফী।।
বন্ধুরা কেউ কেউ শিরোনাম পাল্টে জবানবন্ধী না লিখে রোজনামচা লিখে অনুরোধ করেছে। পেশাদার জীবনে বিশেষত বাংলাদেশে কয়েকবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। বিজিএসল সিস্টেমে গ্যাস চুরি শুরু হবার সূচনাকালে কয়েকবার চট্টগ্রাম বিতরণ এলাকায় নাসিরাবাদ , হালিশহর , কালুরঘাট অঞ্চলে প্রভাবশালী মহলের শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ ঝুঁকি নিয়ে কেটে দিয়েছি। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও বৈরী সময়ে বিয়ানী বাজার -আশুগঞ্জ গ্যাস কনডেনসেট পাইপ লাইনের চুরি বন্ধ করেছি, সংকট সময়ে দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করে ১৯৯৬-৯৭ সালে আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন যথাসময়ে সম্পাদনে ভূমিকা রেখে স্বাধীনতা সপক্ষের সরকারকে স্বস্তি দিয়েছি। জানিনা এগুলো দেশদ্রোহীর পক্ষে করা সম্ভব কিনা। হয়তো আমার আপোষহীন কাজ কোনো মাফিয়া সিন্ডিকেটের স্বার্থে লেগেছিলো। আমি অন্তত দুইটি প্রকল্প আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ পাইপলাইন এবং বিয়ানীবাজার -কৈলাশটিলা পাইপ লাইন নির্মাণে ঠিকাদার নির্বাচনে স্রোতের বিপর্যয়ে কাজ করে সরকারের আর্থিক সাশ্রয় করেছি। জানি এর ফলে কুচক্রী মহল আমার প্রতি হিংসা পরায়ণ ছিল।
বিজিএসএল সূচনা সময়
আমি যখন ১৯৮১ বিজিএসএল যোগদান করি তখন সর্বজনাব চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন, আলাউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোমিনুল হক ,চৌধুরী হাফিজুর রহমান , মাহাবুবুর রহমান , শাহাদাত আলী, অলকেশ চৌধুরী , কামরুল ইসলাম , তৌফিক, আলতাফ , ফারুখ আহমেদ, এনায়েত সহ হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন। ঢাকায় একটা লিয়াজোঁ অফিস এবং কুমিল্লায় পুলিশ লাইন সংলগ্ন এলাকায় একটি কার্যালয় ছিল।আমি ,শহিদুল আবেদীন , আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মিন্টু , সাইফুল চৌধুরী একসঙ্গে যোগদান করি। আগেই লিখেছি কোম্পানি প্রধান আমাকে আমার সদ্দো বিবাহিত স্ত্রী রোজী সোহো নিজের গাড়িতে ড্রাইভ করে কুমিল্লা নিয়ে যান।তখন কিন্তু মেঘনাঘাটে মেঘনা বা দাউদকান্দিতে মেঘনা গোমতী সেতু হয় নি।মনে পরে মহসিন ভাই বিরতি রেস্টুরেন্টে আমাদের দুপুরের খাবার খাইয়েছিলেন। আমরা ৭ দিন কুমিল্লা অতিথি ভবনে থেকে চর্থায় সহকর্মী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহদের একটি বাড়ী মাসিক ৩০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছিলাম। আগেই লিখেছি এড়াতে আমাদের সঙ্গে থাকা সবেধন নীলমনি সু্যটকেইস্ ঢোরে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অবশ্য জিন্নাহ পরিবার তৎপর হয়ে সুইক্যাসেটি উদ্ধার করে কিছু কাপড় ফায়ার পাই। কিন্তু বহু কষ্টে সংগ্রহীত রোজীর বিয়ের দুটি শাড়ি হারিয়ে যায়। আমাদের বাসার পাশে একটি মাছে ভরা পুকুর ছিল। রাতে বিশেষ কৌশলে কৌশলে মাছ ধরতাম। প্রতিদিন শিঙ ,কৈ , সরপুঁটি কিছু না কিছু মিলতো। আমার বালিকা বধু স্বল্প সময়ে বাসায় সবজি বাগান করে ফেলে। ওই সময় কুমিল্লায় মাছ ,সবজি সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সুলভ ছিল। ঢাকা থেকে এসে আমার লেখা লিখি করে বাড়তি উপার্জন সীমিত হয়ে পরে।
খন্দকার মোমিনুল হকের তত্ত্বাবধানে পাইপ লাইন ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় আমি ,আবেদীন, সাইফুল যোগদান করি।মাহবুব ভাই আগে থেকেই ছিলেন। শাহাদাৎ ভাই আর মিন্টু ঢাকায় পরামর্শক পাইপ লাইন টেকনোলজিস্ট ( পিএলটির ) সঙ্গে কাজ করে. উল্লেখ প্রয়োজন পিএলটি বাংলাদেশ প্রধান ছিলেন পেট্রোবাংলার প্রথম চেয়ারম্যান , জ্বালানি সচিব এবং বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা খ্যাতনামা ভুতত্ত্ববিদ ডক্টর হাবিবুর রহমান। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মহান জ্ঞানী এই ব্যাক্তিত্বের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে কাজ করার। উনি আমাকে ডকুমেন্টেশন , মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প পরিদর্শন বিষয়ে অনেক দীক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মহসিন ভাইয়ের দক্ষ নেতৃত্বে আমাদের কাজে লেগেছিলো শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমানের শিক্ষা।
আমাদের কাজ দেয়া হয় বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট সিটি গেট স্টেশন পর্যন্ত গ্যাস পাইপ লাইনের পথসত্ব কোম্পানির দায়িত্বে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ের সঙ্গে কাজ করা। এই সময় ফিরোজ , মুস্তাফিজ , ফিরোজ খান , মাহফুজ আমাদের সঙ্গে যোগদান করে। ফিরোজ খান পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার বিধায় গ্যাস ফিল্ডে তৌফিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগদান করে। শহিদুল আবেদীন ফিরোজকে নিয়ে কুমি,ল্লা অঞ্চল , আমি মুস্তাফিজকে নিয়ে ফেনী ,নোয়াখালী অঞ্চল এবং সাইফুল ,সরোয়ারকে নিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পথসত্ব নির্ভেজাল করতে দায়িত্ব পালন করি।মনে আছে কুমিল্লায় যোগদানের শুরুতেই একদিন মহসিন ভাই আমাকে বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে নিয়ে যান। তখন কুমিল্লা ব্রহ্মণবাড়িয়া সড়ক থেকে গ্যাস ক্ষেত্র পর্যন্ত সাত কিলোমিটার দীর্ঘ নব নির্মিত সংযোগ সড়ক রক্ষা করার জন্য মাহবুব ভাই অনেক ব্যাস্ত ছিলেন। বিশেষত বর্ষাকালে পাহাড়ি গোমতী উত্তাল হয়ে পরে সড়ক ভেঙে দিতো। তখন এই সড়কে কালভার্ট নির্মিত হয় নি আমি ,শহিদুল আবেদীন মাঝে মাঝে মাহবুব ভাইকে সহায়তা করতাম। মাহবুব ভাই ,শহিদুল আবেদীন , মিন্টু, তৌফিক ভাই, কাম্রুল ভাই, অলকেশ দাদা সাইফুলের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সৌহাদ্র গড়ে উঠে।
কুমিল্লার ডিসি ছিলেন অত্যন্ত সংস্মৃতি মনা। কাজের মাদ্ধমে ইনার সাথে ঘনিষ্টতা হয়। আমরা উনার উদ্যোগে কুমিল্লা অঞ্চলে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের অনেক গুলো স্মৃতি ফলক স্থাপনে অংশ গ্রহণ করি।
ইতিমধ্যে ইটাল মোন্তাজি পাইপ লাইনের টিকাদার নির্বাচিত হয়। সঙ্গে সিঙ্গাপুর অফিস থেকে সংযুক্ত হয় চিওড়া কাজী বাড়ির কেবি আহমেদ। এক পর্যায়ে ইতালির কোম্পানি চলে গেলে কেবি আহমেদ আজকের বেক্সিমকোকে সঙ্গে নিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ দায়িত্ব গ্রহণ করে. লাইন পাইপ , ভাল্ব , ফিটিংস , রাপিং সরঞ্জাম ক্রয়ের চুক্তি, চট্টগ্রাম সিটিগেট স্টেশন এবং চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদী ক্রসিংয়ে দুটি চুক্তি হয়। আমি বীর মুক্তি যোদ্ধা স্বনামখ্যাত এসপি মাহবুব আহমেদকে আগে থেকেই চিনতাম। এবার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টিন কবির এবং মেজর নাসিরের সঙ্গে পরিচয় হয়।
কুমিল্লায় জীবন স্মরণীয় ছিল। ফারুক ভাই , হায়দার ভাই সহ পুকুরে মাছ ধরা , পাখি শিকার , তিন যদি পরিষদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রিকেট খেলা , রাতে ফারুক ভাই , সাইফুলদের সঙ্গে রোজি সহ দলবেঁধে ভিসিআরে ভারতীয় চটকদার মুভি দেখায় সময় কাটতো।
কোম্পানিতে সদ্য যোগদান করা জামিল , ফিরোজ খান আমার বাসায় ছিল প্রথম কিছু দিন।
সিদ্ধান্ত হয় ইতালির পাদোয়ায় পাইপ লাইনের ওয়েল্ডার টেস্ট হবে। আমাকে এবং মিন্টুকে নির্বাচন করা হয়। কারণ ওই সময় আমাদের দুইজনের তিতাস গ্যাস থাকা অবস্থায় পাইপ লাইন নির্মাণ ব্যাবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা ছিল। সব প্রস্তুতি নেয়ার পর ২৫ মার্চ ১৯৮২ বিমান যাত্রা নির্ধারিত ছিল। ২৪ মার্চ দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আমাদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়। অবশ্য মিন্টু এবং কিছু দিন পরে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীতে ব্যবহারের জন্য লাইন পাইপের্ কোটিং এবং কংক্রিট কোটিং দেখার জন্য সিঙ্গাপুর যাই. সেখানে ব্রেডের প্রাইস ইয়ার্ডে প্রথম স্বয়ক্রিয় ভাবে পাইপ কোটিং দেখার অভিজ্ঞতা হয়। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক প্রথম সফর বিধায় রোজির জন্য কিছু উপহার আন্তে পারি। ইতিমধ্যে রোজি সন্তান সম্ভবা হয়ে পরে। আমার স্নেহময়ী মা এসে কিছু দিন আমাদের কুমিল্লার বাসায় থাকেন। আমাকে এই সময় মাঝে নাঝে সড়ক পথে চট্টগ্রাম যেয়ে জাহাজ থেকে লাইন পাইপ খালাস করতে হতো। অধিকাংশ দিন রাতে ফিরতাম। মাঝে মাঝে বন্দর সংলগ্ন চিৎ কাত হোটেলে রাত কাটিয়েছি।
চলবে।